সামাজিকতা না কি সামাজিক ব্যাধি: মুক্তমত, মাহবুবা সুলতানা শিউলি

Date:

Share post:

সামিয়া,
বাবা-মায়ের আদরের সবচেয়ে ছোট মেয়ে। ওরা ঁচ বোন।কোন ভাই নেই। বাবা স্কুল শিক্ষক। মা ঘর সংসার দেখাশুনা করেন। অভাব অনটনের সংসারেও বাবা মেয়েগুলিকে লেখাপড়া করিয়েছেন। সামিয়ার বড়, মেঝ, সেজ ও ছোট আপুর ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে। বড় আপা এইচ. এস. সি. পর্যন্ত পড়েছে। বাকিরাও গ্রামের কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করেছে। এত কষ্ট করে তাদের পড়াশুনা করানোর পরও তাদের বিয়ের সময় এবং বিয়ের পরবর্তী আয়োজন গুলি করতে করতে বাবা যেন পঙ্গু হয়ে গেছেন। মায়েরও যেন সব শক্তি নিঃশেষ হয়েগেছে।এখন সামিয়ার পালা। সবে এইচ. এস. সি. দিল। কিন্তু তার গড়ন একটু বাড়ন্ত হওয়ায় দেখতে অনেক বড় দেখা যায়। তার উপর রংটাওশ্যামলা ধাঁচের। তার আপুরা যথেষ্ট ফর্সা থাকার কারণে তাদের বিয়ের যৌতুকের ক্ষেত্রে খুব একটা সমস্যা হয়নি। কিন্তু সামিয়ার গায়ের রং কালো, দেখতে একটু বয়সী দেখার কারণে ভাল প্রস্তাব আসছিল না। তার ওপর সবার ছোট ও আদরের এবং কম মেধাবী। সেইজন্য ওর লেখাপড়ার প্রতিও তেমন মনোযোগ নেই। সামিয়াকে নিয়ে ওর মায়ের চিন্তার শেষ নেই। যাই হোক, মোটামুটি ভাল একটা ছেলের সন্ধান মিলল। ওদের সামিয়াকে বেশপছন্দ হয়েছে। অর্থাৎ যথেষ্ট যৌতুকের বিনিময়ে তারা সামিয়াকে ঘরে তুলতে চায়। বরপক্ষ যেদিন সামিয়াকে দেখতে আসবে, সেদিনের আয়োজনের জন্য বাবা ধারকর্জ করে বিশহাজার টাকা যোগাড় করেছেন। ঐ টাকা দিয়ে প্রথম পর্বের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলো।এবার ২য় পর্ব, হাতে নেই এক পয়সাও। অন্য বোনদের পড়ালেখার খরচ ও তাদের বিয়েতে খরচ করে বাবা একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেছেন। বাবা-মায়ের চোখে ঘুম নেই। টেনশনে টেনশনে নিঃশেষ হয়ে গেছেন। কোন উপায় না দেখে তারা আত্নীয়-স্বজনের ধারস্ত হলেন। এবার আত্নীয়-স্বজনও সবাই বিরক্ত। আগেও তাদের বার বার সাহায্য-িতা করতে হয়েছে। এবার যেন কোন আত্নীয়ও আর সাহায্য করতে চাচ্ছেন না। কিন্তু সামিয়ার বাবা-মায়ের জ্বালাতনে সবাইকেই কিছু না কিছু সাহায্য করতে হয়েছে। শেষসম্বল একটা ছোট জমি ছিল, সেটিও বিক্রি করতে বাধ্য হলেন। আরো কিছু ধার দেনা সহ যা যোগাড় হলো তা দিয়ে বিয়ের যৌতুক থেকে শুরু করে সকল আয়োজন শেষ করলেন। সামিয়াও বাবা-মাকে কাঁদিয়ে, নিজেও অনেক কান্নাকাটি করে নিলো।
কি পাঠক, ভেবেছেন সব ঝামেলা শেষ?
না,এখনো শেষ হয়নি। আরো আছে! এবার ফিরতি নামের আরেক নাটক। সেই নাটকের প্রয়োজনে আবারো ২০-২৫ হাজার টাকার গচ্ছা। তারপর মেয়ে বাপের বাড়ি যাবে, দু’তিন দিন থাকবে। শ্বশুর বাড়ি ফেরার সময় আবারো এটা-ওটা-সেটা কত কিছু করে মেয়ের সাথে করে পাঠাতে হবে, সেই জন্য আবারও ১৫-২০ হাজার টাকার ধাক্কা। নাটক এখানেও শেষ হতে পারত, কিন্তু হয়নি! আরো আছে, সামনে মৌসুমী ফলের সময়। আম-কাঠাঁল-লিঁসহ আরো ন ফল পাঠাও!!রমজান মাস চলে আসল বলে!
কি পাঠক খুব খুশি,কারণ রমজানের ঐ র শেষে এল খুশির ঈদ। কিন্তু সামিয়ার বাবা-মা আতংকিত। কালো মেয়েটার শ্বশুরবাড়িতে বস্তা বস্তা ইফতারির আইটেম যে পাঠাতে হবে! হায়!! আর কয়েকদিন পর খুশির ঈদ। কিন্তু সামিয়ার বাবা-মা কি খুশি? সামিয়ার শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, শ্বাশুড়ীর ৫ বোন, শ্বশুরের ৪ ভাই – ৫ বোনের জন্য শাড়ি, ভাইদের জন্য পাঞ্জাবী, সামিয়ার ৩ ননদের জন্য শাড়ী, ভাসুর ও ভাসুরের বউয়ের জন্য শাড়ি উপহার, ননদদের স্বামীর জন্য উপহার ও বাচ্চাদের জন্য কাপড় চোপড় পাঠাতে হবে।কিন্তু কিভাবে? আমি জানিনা, অনুমান ও করতে পারছি না! আর নাপাঠালে?
এ জন্য সামিয়ার উপর কি কি হতে পারে, আন্দাজও করতে পারছি না!আপাতত এ পর্ব শেষ, এখন নাটকের সামনের পর্বে যাচ্ছি।আহ কি খুশী! সামনে কুরবানী ঈদ। সামিয়ার বাবা-মা এখন কি করবে? আস্ত একটা গরু না হোক, একটা বড় সাইজের ছাগলতো দিতেই হবে। কিন্তু বিয়ের প্রথম বছর গরু পাঠাতে না পারাটা যেন অত্যন্ত অপমানকর অবস্থা! হায়রে! কি রাগ লাগছে! আর পড়তে ইচ্ছে করছেনা? আরেকটু কষ্ট করে পড়ুন প্লিজ, নাটক যে এখনো শেষ হয়নি!এবার একটা সুখবর দিচ্ছি। সামিয়া মা হতে চলেছে। যে শিশু পৃথিবীতে এখনো আসেনি, তার জন্য সামিয়ার মাকে ডজন ডজন নকশীকাঁথা সেলাই করতে হচ্ছে। শরীরটা যেন শেষ হয়ে গেল। আর পারছেন না। শরীরে যেন আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই, তবুও তো এদায়িত্ব থেকে পরিত্রাণের কোন সুযোগ নেই। দিন ঘনিয়ে এলো। ফুটফুটে একটা পুত্র সন্তানের মা হলো সামিয়া। নাতিকে দেখতে যাবে সামিয়ার বাবা-মা। দোলনা ও একটা স্বর্ণের চেইনতো দিতেই হবে, তাই না! কিছুদিন পর বাচ্চার আকিকা দিতে হবে। যেহেতু ছেলে বাচ্চা, নানু বাড়ি থেকে গরু দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে??ফুটফুটে বাচ্চাটি বড় হচ্ছে, তার ছোট ছোট দাঁত উঠেছে। এখন নানু বাড়ি থেকে তার জন্য পোলাও-মুরগীর রোস্ট পাঠাতে হবে। মানে ছোট বাচ্চাটির নাম দিয়ে বাকীরা তা গিলে খাবে!!এভাবে নাটক চলতেই থাকবে…….., চলতেই থাকবে…….., বানানো নানান আয়োজন সাজিয়ে,,, অনন্তকাল……!!!!! এ ধরণের বানানো আনুষ্ঠানিকতা করতে যেয়ে একজন মানুষের ওপরমানুষিক ও শারিরীক যে চাপ সৃষ্টি হয়, সে চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।এখন প্রশ্ন হলো?এগুলি কি সামাজিকতা নাকি সামাজিক ব্যাধি? মেয়ে নামক বিচিত্র প্রাণী গুলি কি মানুষ? নাকি মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার পাবার জন্য তার বাবা-মাকে মরে মরে বাচঁতে হয়!! সাধ্য নেই তবে সাধের লাগাম টানতে পারছেন না কেন তাঁরা ? এসবের বিনিময়ে মেয়ে যেন শ্বশুরবাড়ি তে একটু শান্তিতে থাকতে পারে। এসবের বিনিময়ে মেয়ের সুখের ব্যবস্থা করা।যারা সামর্থ্যবান তাদের জন্য টি হয়তো কিছুটা সহনীয়, কিন্তু সামিয়ার বাবা-মায়ের মতো মানুষগুলোর কি অবস্থা হতেপারে, তা কি এই সমাজ কোন দিনও ভেবে দেখেছে? কে বানিয়েছে এমন নিয়ম-কানুন?বাংলাদেশের গ্রামীন সমাজসহ দেশের আনাচে কানাচে ক্যান্সারের মত এ সামাজিক ব্যাধির পরিধি দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। দেশ পাল্টাচ্ছে কিন্তু এ ব্যাধি নিরাময়তো রের কথা আরো যেন এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কি সামাজিকতার নামে এ সামাজিক ব্যাধি থেকে কখনোমুক্তি পাবে না???
লেখিকাঃ মাহবুবা সুলতানা শিউলি,
সদস্য,বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

যাত্রাবাড়ীতে ১৫১ বোতল বিদেশি মদ ও ট্রাকসহ এক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে ডিবি-রমনা

স্থানীয় প্রতিনিধি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ১৫১ বোতল বিদেশি মদ ও মদ পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাকসহ এক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার...

ডিসি হিলে ঐতিহ্যবাহী নববর্ষের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিকালে হামলা এবং ভাঙচুর,নববর্ষের অনুষ্ঠান বাতিল

স্থানীয় প্রতিনিধি চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালী থানার ডিসি হিলে ঐতিহ্যবাহী নববর্ষের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিকালে হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনায় আগামীকালকের নববর্ষের অনুষ্ঠান...

অভিনেত্রী মেঘনা আলমকে ডিটেনশন আইনে ৩০ দিনের জন্য কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত

সময় ডেস্ক  মিস আর্থ বাংলাদেশ ২০২০-এর বিজয়ী অভিনেত্রী মেঘনা আলমকে ডিটেনশন আইনে ৩০ দিনের জন্য কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার...

কে এই আশিক চৌধুরী

সময় ডেস্ক  পাইলট পরিবারের সন্তান আশিক চৌধুরী। পেশায় ব্যাংকার হলেও রপ্ত করেছেন বিমান চালানো। অন্তত অর্ধশত বার ঝাঁপ দেন...