
ফগার মেশিন দিয়ে মশা নিধনের ঔষধ দেয়া হচ্ছে ঢাকার মিরপুরে একটি পাড়ায়। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে চারপাশ।
কিন্তু এলাকার বাসিন্দা কেজি মুস্তাফা বলছেন তাতে তার তেমন কোন লাভ নেই।
মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া রোগে ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন তিনি ও তার বেশ কিছু আত্মীয়।
আরো অনেকের মতো তিনিও একই ধরনের উপসর্গ বর্ণনা করলেন।
ঢাকা শহরে এখনকার সময়ের আতঙ্কের নাম এডিস মশাবাহিত এই চিকুনগুনিয়া রোগ। বলা হচ্ছে রোগটি এখন ঢাকার সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা।
বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইন্সটিটিউট আইইডিসিআর বলছে ২০০৮ সাল থেকে চিকুনগুনিয়া রোগটি বাংলাদেশে শনাক্ত হলেও, চলতি বছরই সবচেয়ে বেশি প্রকোপ দেখা যাচ্ছে।
সংস্থাটি বলছে ঢাকার ২১টি এলাকায় এই রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
যেহেতু মশা থেকেই এর উপদ্রব তাই মশা নিধনে কার্যক্রমটাই জরুরী ছিলো।
কিন্তু সে নিয়ে ঢাকায় বহু মানুষের নগর কর্তৃপক্ষের প্রতি ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
মি: মুস্তাফা বলছেন মশা নিধনের উদ্যোগ কাছাকাছি সময়ে তিনি এই প্রথম দেখছেন তাও মোটে একবার ঔষধ ছড়ানোর কাজ।
তিনি বলছেন, “এই মাত্র কয়দিন আগে দেখলাম একবার ঔষধ দিয়ে গেছে। এর আগে সর্বশেষ যে কতদিন আগে দিছে মনেই করতে পারি না”।
ঢাকায় বেশ কিছুদিন ধরে প্রতি বছরই দেখা যাচ্ছে এডিস মশা বাহিত আর এক রোগ ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপও। আর ঢাকার আরেক বাৎসরিক উপদ্রবের নাম ডায়রিয়া।
আইইডিসিআর এর উপদেষ্টা ডা: মুস্তাক হোসেন বলছেন, “ঢাকাতে বর্ষার শুরুতে এবং শেষে ডাইরিয়ার প্রকোপ থাকে। বর্ষার সাথে সাথে এডিস মশার বিস্তারের কারণে ডেঙ্গু থাকে। এখন চিকুনগুনিয়া দেখা দিচ্ছে। এছাড়া খাদ্য ও পানিবাহিত রোগ পেটের পিড়া, জন্ডিস বা টাইফয়েড সেগুলোও রয়েছে। এগুলো সারা বছরে আমরা রিপোর্ট পাই”।
তিনি বলছেন, এসব অসুখের উপর নিয়মিত নজরদারি সিটি কর্পোরেশনগুলোর এখনো গড়ে ওঠেনি।
সেই দুর্বলতার একটা বড় চিত্র পাওয়া যায় ঢাকার বস্তি এলাকায় গেলে।
ঢাকার সবচেয়ে বড় বস্তি এলাকা কড়াইলে গিয়ে দেখা গেলো সেখানে চিকুনগুনিয়া রোগী ঘরে ঘরে। কিছুদিন আগে ছিলো ডাইরিয়ার প্রকোপ।
জোবেদা বেগম নামে এক বাসিন্দা বলছিলেন, “মেয়র পারলে আমাদের তাড়াইয়া দেয়। আমাদের মশা কামড়ায়, কুকুরে কামড়ায়, পানিতে ময়লা। সেই পানি খাই। সরকার আমাদের দেখে না”।
জোবেদা বেগমের কন্ঠে স্পষ্ট ক্ষোভের সুর। কড়াইল বস্তিতে ছোট ছোট খুপরি ঘরগুলোর মাঝখান দিয়ে কাদা মাখানো সরু গলি।
শেষ মাথায় কোনোরকমে বসা যায় এমন দুটো টয়লেট।
যার ভেতরে চোখ গেলে গা গুলিয়ে ওঠে। আর এক বাসিন্দা জসীম উদ্দিন দেখাচ্ছিলেন তাদের টয়লেটগুলোর করুন অবস্থা।
তার অংশে হাজার খানেক লোকের জন্য দুটো টয়লেট। যা তারা নিজেরাই বানিয়েছেন।
টয়লেটের বর্জ্য যাওয়ার জন্য নিজেরাই পাইপ বসিয়েছেন। এই এর বর্জ্য যে কোথায় যায় সেনিয়ে তার কোন ধারনাই নেই।
মলমূত্র নিষ্কাশনে তাদের জন্য নেই কোন ব্যবস্থা।
পৃথিবীর যে কোন শহরে নানা অসুখের উৎস এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নগর কর্তৃপক্ষের।
কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব মতে ঢাকার মলমূত্রের মাত্র দুই শতাংশ নিরাপদ নিষ্কাশন হয়।
বাদবাকি পুরোটাই আবারো মিশে যায় প্রকৃতিতে আর তারপর পানির উৎসে।
ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিকস ও ইউনিসেফের তথ্যমতে ঢাকায় সরবরাহকৃত পানির দুই তৃতীয়াংশে মলবাহিত জীবাণু পাওয়া যায়।
আর এটি ঢাকায় জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকির একটি।
যার ফল হলো ঢাকা শহরে বছরে দুবার ডায়রিয়ার উপদ্রব দেখা দেয়।
নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন কাজ করে ওয়াটার এইড। সংস্থাটির কান্ট্রি ডাইরেক্টর খাইরুল ইসলাম বলছেন ঢাকায় সাধারণ মানুষজনের কাছে যে পানি পৌঁছায় তার অবস্থা শেষমেশ নিরাপদ নয় কেন?
তিনি বলছেন, “প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার একটা অন্যতম উপাদান হচ্ছে পানি, পয়:নিষ্কাশন এবং পরিচ্ছন্নতা। পানি সরবরাহের দিক থেকে আমরা অনেকটা এগোলেও ভোক্তা পর্যায়ে যে পানি পৌঁছায় তার মান খুবই খারাপ। তার একটা বড় কারণ হচ্ছে আমরা স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভাল করতে পারিনি। তাই একটু বৃষ্টি হলেই সুয়ারেজ, ড্রেন আর পাইপের পানি সব একাকার হয়ে যায়। নিয়মিত খোঁড়াখুঁড়িও এই মিশ্রণের জন্য দায়ী” ।
তিনি আরো বলছেন, ঢাকার নিম্নবিত্তদের কাছে একেবারেই পৌঁছায়নি স্যানিটেশন ব্যবস্থা।
দেশের সবচেয়ে জনবহুল শহর ঢাকায় জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে সময়মত প্রস্তুতি এবং শহরের নাগরিক সুবিধার অবকাঠামোগত চরম দুর্বলতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনকে।
যেমনটা বলা হচ্ছে গত বছরের ডিসেম্বরে চিকুনগুনিয়ার প্রথম প্রাদুর্ভাব হলে বৃষ্টি শুরুর আগে সে নিয়ে কিছুই করেনি নগর কর্তৃপক্ষ।
অনেকেই অভিযোগ করছেন ব্যাপক সমালোচনার চাপে মাত্র শুরু হয়েছে কিছু ঔষধ ছিটানোর কাজ।
এসব সমালোচনা অবশ্য মানছেন না দুই সিটি কর্পোরেশনের কেউই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলছেন তাদের কার্যক্রম সারা বছরই চলে।
তিনি বলছেন, “আমাদের একটা ওয়ার্ডে চারজনের মতো মশা নিধন কর্মী রয়েছে। তারা সকালে হয়তো লার্ভিসাইড দেয় আবার বিকেলে হয়ত ফগিং করা হয়। তাই হয়তো অনেকের চোখে পড়ে না। কর্মচারীদের হয়ত কিছু অবহেলা থাকতে পারে। সেটা পুরো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু কাজ সারা বছরই চলে”।
কিন্তু তাতে কতটা সমন্বয় আছে?
২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুভাগে ভাগ করার ফলে ঢাকায় এখন দুজন মেয়র।
সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য সেবার ম্যানডেটের আওতায় রয়েছে নগর মাতৃসদন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা, মশা নিধন ও পরিচ্ছন্নতার কাজ।
কিন্তু সেই কাজটি হচ্ছে স্থানীয় সরকারের অধীনে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রয়েছে মূল স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্বে।
সেই সাথে ঢাকা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে রাজউক, ওয়াসাসহ আরো অনেকগুলো সংস্থার কাছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা এস এম সালেহ ভুঁইয়া বলছেন, অনেক সংস্থার সমন্বয় না থাকাটাই তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলছেন, “ঢাকা বিশ্বের সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এই শহর খুব অপরিকল্পিত ভাবে হয়েছে। ঢাকায় রাজউক, ওয়াসা বা সিটি কর্পোরেশন এসব সংস্থাগুলোর সমন্বয় নেই। দেখা যাচ্ছে যেখানে একটা ড্রেন আছে সেটা কোথায় যাচ্ছে তা জানি না। আবার কোন ড্রেনের মালিক কোন সংস্থা, কে কোথায় কখন পরিষ্কার করবে সেটারও একটা সঠিক সক্ষমতা নেই। কিন্তু এখন চেষ্টা চলছে”।
এই সমন্বয় আনতে আর কতদিন লাগবে সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না কারো কাছেই।
তাই মশার কামড়ে জ্বর, দূষিত পানিতে পেটের অসুখ, ময়লার গন্ধে দুর্বিষহ জীবন ঢাকাবাসীর নিত্য দিনের অভিজ্ঞতা।
আর এভাবেই জনস্বাস্থ্যের চরম দুর্বলতা নিয়েই আরো বড় হচ্ছে ঢাকা শহর।