বাংলাদেশে পাঠ্যবই নিয়ে বারবার বিতর্ক কেন?

Date:

Share post:

বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের একটি পাঠ্যবইয়ে ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য কৌশল হিসেবে উল্লেখিত কিছু বিষয়কে নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং শিক্ষা গবেষকদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

কারণ অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যবইতে কৌশল হিসেবে যেসব বিষয় এসেছে সেখানে, বাড়িতে একা না থাকতে, অন্যকে আকর্ষণ করে এমন পোশাক না পরতে, পরিচিত বা অপরিচিত কারো সাথে বাইরে না যেতে বলা হয়েছে।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহল প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলছে, এখানে মেয়েদের টার্গেট করার প্রচলিত ধ্যান-ধারণাই উঠে এসেছে। ফলে পাঠ্যবইকে ঘিরে ভুল-ভ্রান্তি আর বিতর্কের বিষয়টি আবারও সামনে চলে এসেছে।ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার রিফাত সুলতানার বাবা-মা দুজনই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাই দিনের অনেকটা সময় তাকে থাকতে হয় বাড়িতে একাই।

সে বলে, “এখানে আসলে কিছু করার নেই। আমার আব্বু আম্মু যখন থাকে না আমাকে একা একাই থাকতে হয়”।

চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সন্তানরা কখনো কখনো বাড়ির খল্ডকালীন গৃহকর্মীর সঙ্গ পেলেও, রাজধানীর অনেক পরিবারেই এখন এমন চিত্র। বাবা-মায়েরা বিভিন্ন প্রয়োজনে ছেলে বা মেয়েটিকে বাড়িতে একা রেখে বাইরে বের হতে বাধ্য হচ্ছেন হর-হামেশা।

এমন প্রেক্ষাপটে ক্লাস এইটের গার্হস্থ্য-বিজ্ঞান বইতে যৌন নিপীড়ন থেকে বাচার জন্য মেয়েদেরকে বাড়িতে একা না থাকাসহ বেশকিছু কৌশলের নির্দেশনা দেয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।মেয়েদের বিভিন্ন যৌন হামলা থেকে রক্ষার পাঠ নিতে হলে সেটি ছেলে শিক্ষার্থীদেরও পাঠ্যবস্তু হওয়া দরকার মনে করেন, শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। (প্রতিকী ছবি)

বইয়ের ৬৫ নম্বর পৃষ্ঠায় পাঠ-৩-এ বলা হয়, যৌন নিপীড়ন সমবয়সীরা ছাড়াও যেকোনো নিকট আত্মীয়, পরিচিত ব্যক্তি, বয়স্ক যেকোনো সদস্যের মাধ্যমে হতে পারে। বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা থেকে নিজেকে রক্ষা করার পাঠের সপ্তম অধ্যায়ে যৌন নিপীড়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেশকিছু কৌশলের কথা বলা হয়েছে পয়েন্ট করে ।

গার্হস্থ্য-বিজ্ঞান বইটি পাঠ করতে হয় কেবল মেয়ে শিক্ষার্থীদের। তাই প্রশ্ন উঠেছে যৌন নির্যাতন এড়ানো বিষয়ক শিক্ষা কি কেবল মেয়েদেরই নিতে হবে? নাকি ছেলেদের পাঠ্যসূচিতেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা দরকার ?

দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী অমি রহমান বলছিলেন, “আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাবা-মায়েদের সাথে অনেককিছু শেয়ার করা যায়না। আবার পাঠ্যবইতে বা কারিকুলামেও কিছু নেই। আমার মনে হয় আমাদের বইতেও থাকা দরকার। কিভাবে একটি ছেলে একটি মেয়েকে একজন মানুষ হিসেবে সম্মান করবে।”

তার মতে, পাঠ্যবইয়ে এ ধরনের বিভাজন কাম্য নয়। তাহলে ছেলেমেয়ের বিভাজনও গড়ে ওঠে শিশুবয়স থেকেই।স্কুলের সামনে অপেক্ষমাণ অভিভাবকদের অনেকেই বলেন, পাঠ্যবইয়ে ভুল এবং বিতর্কিত বিষয় শিশুদের মধ্যে বিভ্রান্তির কারণ হয়ে উঠছে।

ঢাকার নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নুন স্কুলের সামনে ছুটির সময়টায় বাইরে অপেক্ষমান অভিভাবকদেরদেখা যায় । তাদের কাছে জানতে চাই বিষয়টি নিয়ে তারা কি ভাবছেন?

একজন অভিভাবক মশিউর রহমান বলেন,এখানে পোশাক আশাকের কথা বলে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আসলে ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই এই শিক্ষা দিতে হবে। পরিবার এবং স্কুল সব জায়গা থেকেই দিতে হবে।

আরেকজন মিসেস মজিলা রহমান বলেন, শুধু মেয়েদের ওপর চাপালে হবে না, তাহলে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হবে।

আরেকজন অভিভাবক বলেন, আমি মনে করি এ বিষয়ে পাঠদান দিতে হবে তবে তা দিতে হবে অন্যভাবে। প্রয়োজনে শিক্ষকরা স্কুলে কাউন্সেলিং করবে।

যে বইয়ের বিষয় নিয়ে এই কথাবার্তা হচ্ছে সেটি লেখার ক্ষেত্রে দায়িত্বে ছিলেন ৬/৭ জন। আর তার সম্পাদনার ক্ষেত্রেও ছিলেন একাধিক ব্যক্তি।

পাঠ্যবয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি বইয়ের লেখক, সম্পাদক, বিষয় বিশেষজ্ঞ ও পরিমার্জনকারী থাকেন একাধিক । তারপরও বাংলাদেশে পাঠ্য পুস্তককে ঘিরে বিতর্ক যেন থামছেই না।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলছিলেন, ” যারা এই ধরনের পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন তারা অবশ্যই আমাদের সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় এনেই লিখেছেন। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কেউ যদি এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ থাকে আমাদের কাছে পাঠালে আমরা পাঠ্যসূচি পরবির্জনের সময় তা যাচাই করে দেখবো”।

তিনি জানান, বই লেখেন বিশেষজ্ঞরা, যৌক্তিক মূল্যায়ন হয় এবং তা সংশোধনেরও সুযোগ রয়েছে। কারও কোনো পরামর্শ থাকলে তা বিবেচনায় নেওয়া হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।নবম-দশম শ্রেণীর এই বইটির প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় ভুল অথবা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে সংশোধন কমিটির সদস্যদের কাছে। যদিও প্রতিটি বই তৈরিতে লেখক, সংকলক এবং সম্পাদক থাকেন একাধিক ব্যক্তি।

প্রশ্ন উঠেছে বই রচনা এবং তার সম্পাদনার বিষয় নিয়েও। পাঠ্যবইয়ের মলাট ওল্টালেই যে নামগুলো লেখা থাকে তারা এসব বিষয়ে কতটা সচেতন থাকেন? তারা কি আদৌ বইয়ের বিষয়বস্তুগুলো পড়ে দেখেন?

যে পদ্ধতিতে বাংলাদেশে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয় সে প্রক্রিয়া কতটা যথাযথ সে নিয়ে প্রশ্ন আছে শিক্ষা গবেষকদের।

ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষা ও গবেষনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আক্তারের কথায় তেমনটাই উঠে আসে।

“আমার মনে হয় যারা এই বইগুলো রচনার সাথে জড়িত তারা আদৌ এগুলো পড়েন কিনা সেটাই প্রশ্ন। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণও হয়না। একজন বোর্ডের সমন্বয়ক থাকেন । কোন অসঙ্গতি থাকলে তাকে সেটি দেখতে হবে। কমিটির সবার কন্টেন্ট পড়তে হবে। সম্পাদক কি করেন? তিনি কি না দেখে মুদ্রণের জন্য পাঠিয়ে দেন। লেখকরা যতক্ষণ সন্তুষ্ট না হবেন ততক্ষণ মুদ্রণে পাঠানো যাবে না।”।ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আক্তার

পাঠ্যবইয়ে ভুল ও অসঙ্গতির মাত্রা সাম্প্রতিক সময়ে এতটাই ভয়াবহ রূপ নেয় যার ফলে সরকারি কর্তৃপক্ষ এসব ভুল বিকৃতি অসঙ্গতি চিহ্নিত করতে বিশিষ্ট শিক্ষা ব্যক্তিত্বদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়।

সেই কমিটির একজন সদস্য উদয়ন বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। তার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল নবম দশম শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য বইয়ের ভুল ও অসঙ্গতি তুলে ধরার।

তার যে যেসমস্ত নজির তারা পেয়েছেন তাতে পাঠ্যবই প্রস্তুতে উদাসীনতা আর অজ্ঞতা অনেক বড় করে ধরা পড়েছে তার কাছে।

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, উদাসীনতা এবং অযোগ্যতা নিশ্চই ছিল। নাহলে এত ভুল কেন হবে?

তিনি বলেন, ” হাস্যকর সব ভুল। ২৬২ পৃষ্ঠার বইতে প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় ভুল আর অসঙ্গতি। যত্ন আর মনোযোগের অভাব। সেসঙ্গে যারা লিখেছেন তারা হয়তো ভালো বানান জানেনই না।”।

অতীতে ইতিহাসের বিকৃতি নজরে এলেও এমন করে ভুল ভ্রান্তি ছিলনা বলে জানাচ্ছেন কমিটির সদস্যরা।

কমিটির আরেকজন সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, অনেকরকম দুর্বলতা ছিল। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণকে বড় করে উল্লেখ করেন তিনি।

তার মতে, পাঠ্যবই তৈরির ক্ষেত্রে একধরনের প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের প্রভাব তার নজরে পড়েছে। যার ফলে তাদের রক্ষণশীল চিন্তাধারার প্রভাব পড়ছে বইয়ের পাতায়।পাঠ্যবইতে কোনও ধরনের সংশোধনী আনাও সহজসাধ্য ব্যাপার নয় কারণ লক্ষ লক্ষ বই সংশোধনীতে লেগে যায় দীর্ঘ সময় ।

শ্যামলী নাসরিন চৈৗধুরী জানান সংশোধন কমিটির কাজ করতে গিয়ে শুরুতেই হোঁচট খেতে হয় সদস্যদের।

হেফাজতে ইসলাম যেসব দাবি তুলেছিল তার সাথে শেষপর্যন্ত আপোষ করার বিষয়টিও উঠে আসে তাদের কথায়।

“সমস্যা অনেক ছিল আমরা যখন কাজ শুরু করি তখনই নির্দেশ দেয়া হয় যে শুধু ভুল সংশোধন করা যাবে। কিন্তু আগের বই থেকে যে গদ্য ও কবিতা বাদ পড়েছে সে বিষয়ে শুরুতেই জানিয়ে দেয়া হয় আমরা কন্টেন্টে হাত দিতে পারবো না”।

আর অধ্যাপক আকাশ বলেন, পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে ভোটের রাজনীতির প্রভাব যতক্ষণ পর্যন্ত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত পাঠ্যবইকে ঘিরে বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, “হেফাজতে ইসলামের দবির প্রেক্ষাপটে গল্প কবিতা বাদ দেয়া হয়। তাদের দাবির আসর এখনো আছে বলেই মনে হয়।”

জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবছর ৩৫ কোটি ৪২ লাখের বেশি পাঠ্যবই মুদ্রণ করেছে। পাঠ্যবইতে কোনও ধরনের সংশোধনী আনাও সহজসাধ্য ব্যাপার নয় কারণ এই লক্ষ লক্ষ বই সংশোধনীতে লেগে যায় দীর্ঘ সময় ।

ফলে পাঠ্যবইকে ঘিরে যেকোনো বিতর্ক স্পর্শকাতর তাই যেকোনো বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও তা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা বজায় রাখার কথা উঠে আসছে অভিভাবক এবং গবেষকদের কথায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আবারো এস আলমে আগুন 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় এস আলম গ্রুপের চিনির গুদামের পর এবার তেলের মিলে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের...

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...