সীমান্ত নিয়ে ভারত-চীন ‘গোপন সমঝোতার’ রহস্য

Date:

Share post:

ভারত-চীন সীমান্তে প্যাংগং লে ডোকলাম নিয়ে দুমাসের বেশী হয়ে গেল ভারত আর চীনের মধ্যে বিরোধ চলছে। দুই দেশের সেনারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, আর নেতারা গরম গরম বিবৃতি দিচ্ছেন।

এত উত্তেজনা সত্ত্বেও দুই দেশের বাহিনীই কিন্তু সংযম বজায় রেখেছে, কোনও হিংসাত্মক ঘটনার খবর এখনও পর্যন্ত আসে নি।

ডোকলাম নিয়ে দুই দেশের র্ক প্রায় তলানিতে এসে ঠেকলেও ভারত-চীন সীমান্ত যে রকম নিশ্চুপ, সেটা পাকিস্তান আর ভারতের সীমান্তে দেখা যায় না।

সেখানে নিয়মিত গুলি বিনিময় হয় দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে, মাঝে মাঝেই দুই দেশের সেনাসদস্যদের মৃত্যুও হয়।

কিন্তু ভারত-চীন সীমান্তে বড়জোর দুই বাহিনীর মধ্যে হাতাহাতি হয় – তার বেশী কিছু না।

দুই দেশের ে দুই সীমান্তে কেন দুই চিত্র?

চীনে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিক শৈবাল দাসগুপ্ত বলছেন, “ভারত আর চীনের মধ্যে একটা সমঝোতা আছে যে যতই মতভেদ হোক, সীমান্তে উত্তেজনা কোনও দেশই বাড়তে দেবে না।

অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন চীনে এসেছিলেন, সেই সময়েই তিক প্রেক্ষিতটা তৈরি হয়েছিল। পরে মনমোহন সিংয়ের আমলেও সেই একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে।”

“দুটো দেশের মধ্যে এরকম সিদ্ধান্ত রয়েছে যে ফ্রন্ট লাইনে যেসব সেনা সদস্য মোতায়েন থাকবেন, তাঁদের কাছে কোনও রকম অস্ত্র থাকবে না। যদি সেনা র‍্যাঙ্ক অনুযায়ী কোনও অফিসারের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রাখা নিয়ম হয়, তাহলে তার নল মাটির দিকে ঘুরিয়ে রাখা থাকবে। সেজন্যই দুই দেশের সেনাসদস্যদের হাতাহাতি বা কুস্তি করার ভিডিও দেখা যায়, কোথাও গুলি বিনিময়ের ছবি দেখা যায় না। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এরকম কোনও চুক্তি নেই,” বলছিলেন মি. দাশগুপ্ত।

ভারত আর চীনের সেনাদের মধ্যে যখন উত্তেজনা বেড়ে যায়, বা হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছয়, সেইসময়েও কয়েকটা দিকে নজর রাখা হয়।

দুই দেশের সেনাদের মধ্যে হাতাহাতির যেসব ভিডিয়ো দেখা যায় গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে, সেগুলো যদি কেউ খুঁটিয়ে দেখেন, তাহলেই বোঝা যাবে সৈনিকরা যেন বাচ্চাদের মতো কুস্তি লড়ছে।

একে অপরকে ধাক্কা দেয়, কেউ পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু কেউ কাউকে চড়-থাপ্পড় মেরেছে, এটা দেখা যায় না। চড় মারা অপমান করার সামিল।

তাই ধাক্কাধাক্কির সময়েও কেউই হাত ব্যবহার করে না। নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই সেনা সদস্যরা এটা করে থাকেন।

চীন আর ভারত একের পর এক সমঝোতা চুক্তি করেছে লাদাখের বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় ভারত ও চীন প্রায়ই পরস্পরের বিরুদ্ধে অন্যের এলাকায় ঢুকে পড়ার অভিযোগ এনে থাকে

সরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা বলছিলেন, “১৯৭৫ সালে শেষবার ভারত আর চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে গুলি চলেছিল। সেই ঘটনায় কোন পক্ষেরই কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, কিন্তু সেটার পুনরাবৃত্তি হয় নি। নিয়মিত সমঝোতা আর আলোচনার মাধ্যমেই লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের সমস্যাগুলোকে দুই দেশই ব্যাক বার্ণারে ঠেলে দিয়েছে।”

১৯৯৩ সালে নরসিমহা রাও যখন ভারতের ্রী ছিলেন, সেই সময়ে মেইন্টেন্যান্স অফ স এন্ড ট্র্যাঙ্কুয়েলিটি চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়েছিল।

১৯৯৬ সালে আস্থা বর্ধক ব্যবস্থাপত্রে সই করে দুই দেশ। ২০০৩ আর ২০০৫ সালেও চুক্তি হয়েছে। আর ২০১৩ সালে সই হওয়া বর্ডার ডিফেন্স কোঅপারেশন এগ্রিমেন্টই এ বিষয়ে সর্বশেষ চুক্তি।

মেজর জেনারেল মেহতার কথায়, “সীমান্তের যে অংশগুলো অমীমাংসিত, সেখানে দুই দেশই শান্তি বজায় রাখে আর নির্দিষ্ট চুক্তি থাকার ফলে কোথাও গুলি চলে না। দুই দেশই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগেই যে সীমান্ত সমস্যাগুলো নিয়ে তখনই ভাবা যেতে পারে যখন আমাদের মধ্যে অর্থনৈতিক আর নাগরিক সম্পর্কগুলো পাকাপোক্ত হয়ে উঠবে।”

পাকিস্তানের সঙ্গে এমন কোনও সমঝোতা নেই ভারতের

ভারত পাকিস্তান সীমান্ত নিয়ে মি. মেহতা বলছেন, “১৯৪৯ এর করাচি চুক্তি অনুযায়ী সিজ ফায়ার লাইন বা অস্ত্র বিরতি রেখা নির্ধারিত হয়েছিল।

১৯৬৫-র যুদ্ধে ওই রেখায় কোনও বদল ঘটে নি। কিন্তু ৭১-এর যুদ্ধে ভারতের কাছে যখন প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানী সেনা যুদ্ধবন্দী হয়ে গিয়েছিল, সিজফায়ার লাইনটিকে সেই সময়েই এল-ও-সি, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ রেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। আর এই এল-ও-সি তে অস্ত্র বিরতির ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে কোনও চুক্তি নেই।”

পারভেজ মুশারফ যখন প্রেসিডেন্ট আর সেনাপ্রধান ছিলেন, সেই সময়ে, ২০০৩ সালে নভেম্বরে পাকিস্তানের তরফ থেকেই একটা সমঝোতা পত্র এসেছিল পাকিস্তানের তরফ থেকেই।

সেখানে প্রস্তাব ছিল যে এল-ও-সিতে অস্ত্র বিরতি হওয়া উচিত। যতদিন মি. মুশারাফ প্রেসিডেন্ট ছিলেন, ততদিন ওই অস্ত্র বিরতি চালু ছিল।

বলা যায় প্রায় ৮০ শতাংশ সফল হয়েছিল ওই সমঝোতা। কিন্তু ২০০৮ সালে মি. মুশারাফ চলে যাওয়ার পর থেকে ওই সমঝোতা পত্রের গুরুত্ব কমতে থাকে।

“এখন যা পরিস্থিতি, তাতে লাইন অফ কন্ট্রোল হয়ে গেছে লাইন অফ নো কন্ট্রোল। কোনও অস্ত্র বিরতিই আর নেই সেখানে,” বলছিলেন মেজর জেনারেল মেহতা।

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনার প্রসঙ্গে শৈবাল দাসগুপ্তর মন্তব্য, “নওয়াজ িফ আর সমস্ত সমস্যা নিয়েই ভাবনাচিন্তা করেছেন। কিন্তু ভারত আর পাকিস্তান – দুই দেশেই এমন কিছু শক্তি আছে, বিশেষ করে টেলিভিশন রেটিং পয়েন্টসের পেছনে দৌড়নো কিছু গণমাধ্যম, যারা আসলে খড়ের গাদায় আগুন লাগানোর কাজটা সমানে করে চলে। শান্তি বজায় থাকার সম্ভাবনাগুলোও ধীরে ধীরে কমে আসে এর ফলে। অবস্থা এখন এমনই, পাকিস্তান আমাদের জন্য একটা অবসেশন হয়ে গেছে, আর পাকিস্তানীদের কাছে কাশ্মীর।”

ভারত-চীনের মধ্যে সংযমের বাঁধ কি ভাঙ্গছে?

কিছুদিন আগে লাদাখে ভারত আর চীনা বাহিনীর মধ্যে কথিত পাথর ছোঁড়াছুঁড়ির একটা ঘটনা জানা গেছে। তার মানে কি দুই দেশের সৈন্যদের মধ্যে সংযমের বাঁধ ভাঙ্গছে?সীমান্ত নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছে – ফাইল ছবি

মি. দাশগুপ্তর মতে, বিষয়টা যথেষ্ট চিন্তার।

“সত্যিই যদি ওই ঘটনা হয়ে থাকে, তাহলে শান্তি বজায় রাখার যে তিহ্য আছে দুই দেশের মধ্যে, তা কোথাও বোধহয় ভাঙ্গতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে সেক্ষেত্রে। ইতিহাস বলে, সবসময়েই রাজারা যুদ্ধ বাধান নি কিন্তু, কোনও একটা ভুলের ফলে যুদ্ধ বেঁধেছে,” বলছিলেন শৈবাল দাশগুপ্ত।

“চীন আর ভারত – দুই দেশের তরফেই সীমান্তে যে সৈনিকরা রয়েছে, তারা ২১-২২ বছরের যুবক। তাদেরও পরিবার আছে যারা রেডিও শোনে, টিভি দেখে। গণমাধ্যম যদি উত্তেজনা তৈরি করে, তার প্রভাব তো ওই যুবক সৈনিকদের ওপরেও পড়ে। যতই নিজের নিজের সরকার নির্দেশ দিক শান্তি বজায় রাখ বলে, সংযম তো কোথাও ভেঙ্গে যেতেই পারে, ভুল করে হলেও,” বলছিলেন মি. দাশগুপ্ত।

তাঁর উপদেশ, সীমান্ত সমস্যা মেটানোর জন্য অনেক দূর যেতে হবে।

কিন্তু সাম্প্রতিক উত্তেজনা খুব তাড়াতাড়ি প্রশমন করা খুব দরকার, কোথাও গুলি বিনিময় না হয়ে যায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আমেরিকা পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন ইলন মাস্ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পর নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার ঘোষণা দিয়েছেন...

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সদস্য সচিব নিজাম উদ্দিনকে সাময়িকভাবে পদ থেকে বরখাস্ত

ডেস্ক নিউজ সংগঠনের নীতিমালা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সদস্য সচিব নিজাম উদ্দিনকে...

গাজায় একদিনে ৭০ জন নিহত, সকাল থেকে ৪৭ জনকে হত্যা

গত ২৪ ঘণ্টায় উপত্যকাজুড়ে বিভিন্ন হাসপাতালে কমপক্ষে ৭০ জনের লাশ আনা হয়েছে। একই সময়ে ৩৩২ জন আহত ব্যক্তি...

পাঁচটি সামরিক স্থাপনায় ইরানের সফল হামলার বিষয়ে ইসরায়েল নীরব: টেলিগ্রাফ

মার্কিন ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের পরিচালিত স্যাটেলাইট তথ্য বিশ্লেষণের বরাত দিয়ে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, একটি বৃহৎ বিমানঘাঁটিসহ...