যেভাবে হিন্দু তীর্থস্থান অমরনাথ খুঁজে পেয়েছিলেন এক মুসলিম

Date:

Share post:

অমরনাথের যাত্রাছবির কপিরাইট Getty Images
Image caption হিন্দু াণে বর্ণিত অমরনাথ গুহা প্রায় ৫০০ বছর গে ুঁজে বের করেছিলেন একজন মুসলমান মেষ পালক।

ভারতে হিন্দু তীর্থক্ষেত্র অমরনাথ থেকে পূজা শেষ করে ফেরার পথে গত সোমবার জঙ্গিদের হামলায় সাত জন তীর্থযাত্রী নিহত হওয়ার পর এর নিন্দায় সরব হয়েছেন ভারতশাসিত কাশ্মীরের হিন্দু-মুসলমান সহ সব ধর্মের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে িক নেতা সবাই।

এমনকি যাঁরা কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতার জন্য আন্দোলন করছেন, সেই সব নেতারাও ওই ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন।

তবে শ্রীনগরে বিবিসির সংবাদদাতা মাজিদ জাহাঙ্গীর লিখছেন, হিন্দুদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থানের সঙ্গে মুসলমানদের নিবিড় সম্পর্ক বহু শতকের।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতি পবিত্র তীর্থস্থান ভারতশাসিত কাশ্মীরের এই অমরনাথ গুহা। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ দীর্ঘ পাহাড়ী পথ পেরিয়ে খুব কষ্ট করে পৌঁছান ওই গুহায়।

কিন্তু হিন্দু পুরাণে বর্ণিত অমরনাথ গুহা প্রায় ৫০০ বছর আগে খুঁজে বের করেছিলেন একজন মুসলমান মেষ পালক।

বুটা ক নামের ওই মেষ পালকের পরিবার তাই এখনও এই হিন্দু তীর্থযাত্রার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকেন প্রতি বছর।

তাঁর বংশধরেরা এখনও বাস করেন পহেলগাঁওয়ের কাছে বটকোট নামের একটি গ্রামে।

পরিবারের সপ্তম পুরুষ গুলাম হুসেইন মালিক বলছিলেন যে তাঁরা পারিবারিক ইতিহাস থেকেই জেনেছেন, কীভাবে বুটা মালিক খুঁজে পেয়েছিলেন অমরনাথ গুহা।

“ঘটনাটা শুনতে একেবারে পৌরাণিক কাহিনীর মতো। বুটা মালিক মেষ পালন করতেন। দূরের পাহাড়-পর্বতে ড়া-ছাগল চড়াতে যেতেন তিনি। সেই পর্যায়েই এক সাধুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়” – বিবিসিকে বলছিলেন মি. মালিক।

ছবির কপিরাইট Majid Jahangir/BBC
Image caption তাঁর বংশধরেরা এখনও বাস করেন পহেলগাঁওয়ের কাছে বটকোট নামের একটি গ্রামে।

একবার প্রবল শীতের হাত থেকে বাঁচতে বুটা মালিক একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সঙ্গে ওই সাধুও ছিলেন। ভেতরেও খুব ঠান্ডা লাগছিল বুটা মালিকের। তখন ওই সাধু একটা কাঙ্গরি দিয়েছিলেন বুটা মালিককে।

কাশ্মীরে শীতের হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষজন একটা ছোট ঝুড়ির মধ্যে কাঠকয়লার আগুন জ্বালিয়ে ঢোলা পোষাকের ভেতরে রেখে দেন। ওই ঝুড়িকেই কাঙ্গরি বলে।

গুলাম হুসেইন মালিক বলছিলেন, “সকালবেলায় বুটা দেখেছিলেন যে ওই কাঙ্গরিটা একটা সোনার কাঙ্গরি হয়ে গেছে।”

মি. মালিকের পারিবারিক ইতিহাস বলছে, গুহা থেকে বের হতেই বুটা মালিক দেখেন সামনে অনেক সাধু-সন্তের একটা মিছিল চলছে। তাঁরা ভগবান শিবের খোঁজ করছিলেন ওখানে।

“বুটা ওই সাধু-সন্তদের জানান যে ভগবান শিবের সঙ্গে তাঁর একটু আগেই দেখা হয়েছে গুহার ভেতরে। সাধুদের তিনি গুহায় নিয়ে যান। দেখা যায় বরফের তৈরি এক বিশাল শিবলিঙ্গ রয়েছে, সঙ্গে পার্বতী আর গণেশও আছেন”- জানাচ্ছিলেন গুলাম হুসেইন মালিক।

ওই ঘটনার কথা ানি হতেই অমরনাথে তীর্থযাত্রা শুরু হয়।

তবে একটা সময়ে বেশ কয়েকজন সাধুসন্ত গুহার পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। তখন সেখানকার মহারাজ রঞ্জিত সিং অমরনাথ যাত্রা বন্ধ করে দেন।

ছবির কপিরাইট Getty Images
Image caption অমরনাথ যাত্রার সময়ে ভক্তদের দান করা অর্থের এক-তৃতীয়াংশ বুটা মালিকের পরিবার পেত।

“আমরা তো মুসলমান। হিন্দুদের পূজা-পাঠের ব্যাপারে আমাদের পূর্বপুরুষরা কিছুই জানতেন না। যাত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে পাশের গণেশ্বর গ্রাম থেকে কয়েকজন কাশ্মীরী পন্ডিতকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের পরিবারের সদস্যরা। তাঁরাই অমরনাথে পূজা লিয়ে যেতে থাকেন” – জানালেন মি. মালিক।

এখনও অমরনাথে তিন ধরনের মানুষ বাস করেন – কাশ্মীরি পন্ডিত, মালিক পরিবার আর সাধুসন্তরা।

এঁরাই অমরনাথ যাত্রার সূচনা করেন ‘ছড়ি-মুবারক’ শোভাযাত্রার মাধ্যমে।

যে গ্রামে মালিক পরিবার এখনও থাকেন, পহেলগাঁও এলাকার সেই গ্রামের নামও বুটা মালিকের নাম অনুসারেই – ‘বটকোট’।

“একসময়ে অমরনাথ তীর্থযাত্রীরা পায়ে হেঁটে আমাদের গ্রামে পৌঁছাতেন। গ্রামের মহিলা, পুরুষ, বাচ্চা – সবাই মিলে তাঁদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। ছড়ি-মুবারক শোভাযাত্রা দেখতে গোটা গ্রাম অপেক্ষা করে থাকতো। মেয়েরা কাশ্মীরী গান গাইত। আমরাই হিন্দু তীর্থযাত্রীদের গুহায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম। আবার গুহা থেকে নেমে আমাদের গ্রামে এসে অনুমতি নিয়ে ফিরে যেতেন তীর্থযাত্রীরা। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ কখনোই ছিল না” – বলছিলেন মি. মালিক।

হিন্দু তীর্থযাত্রীরা যেহেতু অমরনাথ যাত্রার সময়ে আমিষ খান না, তাই মালিক পরিবারের সদস্যরা ওই সময়ে মাংস খান না।

সংস্কৃত ভাষায় কবি কল্হনের া কাশ্মীরের ইতিহাস রাজতরঙ্গিনীতেও মালিক পরিবারের যেমন উল্লেখ রয়েছে, তেমনই অমরনাথ যাত্রা নিয়ে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় যে আইন পাশ হয়েছে, সেখানেও মালিক পরিবারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও কাশ্মীরে গেলেই মালিক পরিবারের কথা স্মরণ করতেন।

কিন্তু বুটা মালিককে সেই সাধুর দেওয়া কাঙ্গরি – যেটা পরের দিন সোনার কাঙ্গরি হয়ে গিয়েছিল – সেটার খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।

ছবির কপিরাইট Majid Zahangir/BBC
Image caption গুলাম হুসেইন মালিক

গুলাম হুসেইন মালিক জানাচ্ছেন, সেই সময়কার রাজারা কাঙ্গরিটা তাঁদের পরিবারের কাছ থেকে নিয়ে নেন। তারপর থেকে সেটার আর কোনও খোঁজ নেই। বহু খুঁজেও পাওয়া যায়নি সেই সোনার কাঙ্গরি।

অমরনাথ যাত্রার সময়ে ভক্তদের দান করা অর্থের এক-তৃতীয়াংশ বুটা মালিকের পরিবার পেত।

“কিন্তু ২০০২ সালে অমরনাথ শ্রাইন বোর্ড তৈরি হওয়ার পর থেকে আমাদের পরিবারকে যাত্রার সবরকম কাজ থেকে দূরে রাখা হয়। আমাদের বলা হয়েছিল মুসলমানদের ওয়াকফ বোর্ডে তো কোনও হিন্দু নেই, তাই শ্রাইন বোর্ডে মুসলমান কী করে থাকে!” – বলছিলেন গুলাম হুসেইন।

পরিবারের আরেক সদস্য মালিক আফজাল বলছিলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষরা ভগবান শিবের দর্শন পেয়েছিলেন। অমরনাথ গুহায় পৌঁছানোর যে প্রথম কাঁচা রাস্তাটি ছিল, সেটিও বুটা মালিকই বানিয়েছিলেন। এখনও আমরা প্রতি বছর গুহায় যাই যাত্রীদের বিনামূল্যে ওষুধপত্র বিলি করতে। যাত্রীরাও পরম্পরা মেনে আমাদের বাড়িতে দেখা করতে আসেন।”

হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ঘোড়ায় অথবা ডুলিতে করে কঠিন পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে নিয়ে যান যারা, তাঁরাও সবাই স্থানীয় মুসলমান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আমেরিকা পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন ইলন মাস্ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পর নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার ঘোষণা দিয়েছেন...

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সদস্য সচিব নিজাম উদ্দিনকে সাময়িকভাবে পদ থেকে বরখাস্ত

ডেস্ক নিউজ সংগঠনের নীতিমালা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সদস্য সচিব নিজাম উদ্দিনকে...

গাজায় একদিনে ৭০ জন নিহত, সকাল থেকে ৪৭ জনকে হত্যা

গত ২৪ ঘণ্টায় উপত্যকাজুড়ে বিভিন্ন হাসপাতালে কমপক্ষে ৭০ জনের লাশ আনা হয়েছে। একই সময়ে ৩৩২ জন আহত ব্যক্তি...

পাঁচটি সামরিক স্থাপনায় ইরানের সফল হামলার বিষয়ে ইসরায়েল নীরব: টেলিগ্রাফ

মার্কিন ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের পরিচালিত স্যাটেলাইট তথ্য বিশ্লেষণের বরাত দিয়ে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, একটি বৃহৎ বিমানঘাঁটিসহ...