পরাধীনতার শৃঙ্খল ও পরাজয়ের অপমান ছিল বাঙালির নিত্যসঙ্গী। ১৯৪৭ সালে অবৈজ্ঞানিক ও সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করলেও নব্য পশ্চিমা শোষণ ছিল তার চেয়েও নির্মম।
এ সময় পুরান ঢাকার মোগলটুলীতে কিছু তরুন শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের স্বপ্ন দেখেছিল। সেই স্বপ্নের বীজ বুনেছিলে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কেএমদাস লেনের কাজী বশির হুমায়ুনের রোজ গার্ডেন বাড়ির দোতলায়। সেই বীজ থেকেই জন্ম হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। আওয়ামী ফার্সি শব্দ যার অর্থ জনগন। অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ। উল্লেখ্য পাকিস্তান সৃষ্টির পর সাধারণ মানুষের মুসলিম লীগের সদস্য পদ লাভ কঠিন ছিল। মাওলানা আকরাম খাঁ সহ সিনিয়র নেতারা এটাকে অভিজাত শ্রেণির দলে পরিণত করেন। এই প্রতিক্রিয়া আওয়ামী নামের একটি কারণ।কারগারে থাকা অবস্থায় তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৪৯ সালের ২৮ জুন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব দলের হাল ধরেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারলে তাদের দাসত্বের শৃঙ্খল আবার পরতে হবে। মাতৃভাষার অপমান কোন জাতি সহ্য করতে পারেনা” পৃ-১৯৭। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব নেন ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট এর নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ও যুক্তফ্রন্ট এর বিজয় আওয়ামী মুসলিম লীগ ও তরুন নেতা শেখ মুজিবকে জনমানুষের অন্তরে স্থান লাভ করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তাই বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক গণমানুষের দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে রূপ দেন।স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-তে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ও ৭০ এর নির্বাচনে নিরুঙ্কুশ বিজয় আওয়ামী লীগ বাঙালির মুক্তির কান্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মানুষ মনস্তাত্ত্বিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই দল আর এই নেতাই হবে আমাদের চুড়ান্ত মুক্তির দিশারী। যা প্রমানিত হয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি সংকট, সংগ্রামে, বিপ্লবে, বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সবকিছুতে প্রাণভোমরা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর ইতিহাসের চাকা পেছনে ঘুরতে শুরু করে। শুরু হয় ক্যান্টমেন্টে বসে ইতিহাস দখলের অপচেষ্টা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে জীবনের ঝুকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আগমনের ফলে আওয়ামী লীগ এর নবযাত্রা শুরু হয়। জাতির পিতার রক্তের উত্তরাধিকারকে কাছে পেয়ে বাংলার সাধারণ মানুষ তাঁকে আকুন্ট সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু ঘাতকেরা ২৪ বার তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। নিয়তির সুবিচার তিনি আজও আমাদের মাঝে আছেন।
তাঁর নেতৃত্বে আজ আওয়ামী লীগ বাঙালির আস্থা ও বিশ্বাসের শেষ আশ্রয়স্থল। একযুগের মত টানা ক্ষমতায় তিনি কখন ও উন্নয়নমাতা, কখন ও মাদার অব হিউম্যানিটি। উন্নয়ন, অগ্রগতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর একটি প্রবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘সব বিকল্পের বিকল্প আছে, কিন্তু শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই।’ এককথায় বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সবকিছু আজ আওয়ামী লীগ এর সাথে মিসেছে একটি মোহনায়। গৌরবের ৭১ বছরে আওয়ামী লীগ আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। যার ছায়াতলে প্রাণ জুড়ায় বাংলার, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ। এই পথচলায় অনেকে জীবন উৎসর্গ করেছেন, অনেকে ছিল, এখন নেই, অনেকে নতুন আসছে। যে যেখানে থাকুক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষ বার বার ফিরে আসে একই ঠিকানায়। যতদূরে থাকুক, তারা অনুভূতিতে কাছে থাকে।
আওয়ামী লীগ এর প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যথার্থ বলেছেন ‘আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম’।
লেখক:মোহাম্মদ বেলাল হোসেন
ইতিহাস বিষয়ক গবেষণাকর্মী।
অনুভূতির আওয়ামী লীগ; গৌরবের ৭১ বছর
Date:
Share post: