বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে ভারতের যেখানে উভয়সঙ্কট

Date:

Share post:

গত বছর অগাস্টের শেষ সপ্তাহে যখন মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার ঢল নামা শুরু হয়েছিল, তখন এই শরণার্থী সঙ্কট নিয়ে কোনও মন্তব্য না-করে ভারত উদ্বেগ জানিয়েছিল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির সহিংস কর্মকান্ডে।

পরে কিছুটা বাংলাদেশের কূটনৈতিক চাপে তারা এই শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মিয়ানমারের সমালোচনা করে এখনও কোনও বিবৃতি দেয়নি।

তবে পর্যবেক্ষকরা জানাচ্ছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে পর্দার আড়ালে ঠিকই কথাবার্তা চালাচ্ছে।

এই পটভূমিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হওয়ার এক বছরের মাথায় কাঠমান্ডুতে বিমস্টেক জোটের শীর্ষ সম্মেলনে বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো একসঙ্গে মিলিত হচ্ছেন বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের সর্বোচ্চ নেতারা।

কিন্তু এই গত এক বছরে ভারতের রোহিঙ্গা কূটনীতিতে আদৌ কি কোনও পরিবর্তন এসেছে? এসে থাকলে সেটা কীরকম?

গত বছর সেপ্টেম্বরের গোড়ায় রোহিঙ্গা সঙ্কট যখন তুঙ্গে, ঠিক তখন মিয়ানমার সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটিবারের জন্যও সে প্রসঙ্গ তোলেননি।

অথচ এই সঙ্কটের ধাক্কা যাদের সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে, সেই বাংলাদেশ চেয়েছিল রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ভারত মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করুক।

এর পরে রোহিঙ্গারা যাতে রাখাইন প্রদেশে ফিরতে পারে সে পথ প্রশস্ত করতে ভারত নানা উদ্যোগ নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মিয়ানমারের ওপর দিল্লি চাপ প্রয়োগ করছে এমন কোনও ধারণা যাতে তৈরি না-হয় সে ব্যাপারেও সতর্ক থেকেছে।

মিয়ানমারে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত জি. পার্থসারথি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমরা এই বিপদে বাংলাদেশকে সাহায্য করারই চেষ্টা করছি। কিন্তু সেই ভূমিকা আমরা পালন করতে পারব না যদি আমরা এখানে অন্যের দোষ-ত্রুটি বিচার করতে বসি। আমাদের প্রধান দুশ্চিন্তা হল বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে আনা, তারা তো এখনও সেখানেই রয়ে গেছে – তাই না?”

“ভারত ঠিক সেই চেষ্টাই করছে, এখানে কার দোষ ছিল, কী ছিল খুঁজতে গেলে কোনও লাভ নেই। আর রাখাইন প্রদেশের ভেতর দিয়েই তো আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে সিতওয়ে বন্দর পর্যন্ত আমরা রাস্তা বানাচ্ছি, সেটাও তো দেখতে হবে।”

মিয়ানমারে ভারতের এমন অনেক স্বার্থ জড়িত বলেই ভারত রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাদের প্রতি খুব একটা কঠোর হতে পারছে না, এমন একটা ধারণাও তাই তৈরি হয়েছে।

দিল্লির ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের ফেলো পুষ্পিতা দাসও জানাচ্ছেন, ভারতে আসা রোহিঙ্গাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে ভারতের যে নীতি, তা এখনও বহাল আছে।

তার কথায়, “ভারতে রাষ্ট্রের ঘোষিত নীতিই হল রোহিঙ্গারা ন্যাশনাল সিকিউরিটি থ্রেট। ভারত সেই সঙ্গে এটাও চায় যে রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরে যাক, মিয়ানমারকে সেটা বোঝানোরও চেষ্টা চলছে।”

“বস্তুত এ বছরের গোড়ায়, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে এই লক্ষ্যে ব্যাকডোর ডিপ্লোম্যাসি করে এবং আরও নানা ভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত আলোচনাও চালিয়েছে। এমন কী একটা সমঝোতাও হয়েছিল যে মিয়ানমার তাদের লোকজনকে ফিরিয়ে নেবে, আর রাখাইনে বাড়িঘর বানিয়ে দিতে ভারত প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড মেটেরিয়াল ও অন্যান্য সরঞ্জাম দেবে।”

রাখাইনে বাড়িঘর নতুন করে বানিয়ে দিয়ে ভারতে যেমন দেখাতে চাইছে তারা চায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক, তেমনি নতুন করে একজনও রোহিঙ্গা যাতে ভারতে ঢুকতে না-পারে সে জন্য সীমান্তেও কড়া নজরদারি চলছে।

মাসখানেক আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং পার্লামেন্টে জানিয়েছেন, “রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিএসএফ ও আসাম রাইফেলস বিশেষভাবে সতর্ক রয়েছে।”

তিনি আরও বলেছেন, “এখন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেকে সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে, সে কাজ শেষ হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ডিপোর্টেশন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলবে।”

কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ফেরানো নিয়ে ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে প্রকাশ্যে বা সরাসরি কথা বলতে মুশকিলে পড়েছে – কারণ উভয়েই ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র।

গবেষক পুষ্পিতা দাসের কথায়, বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে মিয়ানমারেও ভারতের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ এতটুকুও কম নয়।

ড: দাস বলছিলেন, “দেখুন, বাংলাদেশের মতোই মিয়ানমারের সঙ্গেও আমাদের দীর্ঘ সীমান্ত আছে। আমরা মিয়ানমারের ওপর বেশি চাপ দিতে পারব না, কারণ ওই সীমান্ত পেরিয়েই ভারতের জঙ্গীরা যাতায়াত করে আর তাদের মোকাবিলার জন্য মিযানমারের সাহায্য ভীষণ দরকার। আমাদের নিরাপত্তা মানচিত্রে চীনের ছায়াও ক্রমশ প্রবল হচ্ছে।”

“এই সব ভূরাজনৈতিক বা নিরাপত্তা ফ্যাক্টরের কারণেই একটা পর্যায়ের বেশি বাংলাদেশকে সাহায্য করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। তবু যতটা পারা যায় করা হচ্ছে, মিয়ানমারকেও বোঝানো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিলে তোমরা অন্যভাবে সাহায্য পাবে।”

ফলে এক বছরের পুরনো রোহিঙ্গা ইস্যু ভারতের জন্য যে এক বিরাট কূটনৈতিক ডিলেমা বা উভয়সঙ্কট – তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

সেই সঙ্কটের চরিত্র বিশেষ বদলায়নি বলেই দু-নৌকায় পা দিয়েই ভারত এখনও সেই বিপদ উতরোতে চাইছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...

চিত্র নায়িকা নিপুণ চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করছেন

মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন তিনি। জানা গেছে,...