
কাহিনীর শুরু বাংলাদেশের সাতক্ষীরায়।
ভারতের কলকাতার নাট্যকার প্রবীর মণ্ডল বেশ কবছর আগে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরার একটি গ্রামে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লোকমুখে শোনেন গিরেন নামে জনদরদী “অদ্ভূত” এক চোরের কথা।
মি মণ্ডল বিবিসিকে বলছিলেন, “গিরেন হিন্দু হলেও হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অভাবী মানুষের দিকে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। কিন্তু সেই সাহায্য করার উপায়টা ছিল চুরি করা। এক অদ্ভূত মানুষের জীবনকাহিনীর ওপর ভিত্তি করেই এই নাটকটি লেখা।”
প্রবীর মন্ডলের দাবী সেই কাহিনী লোকমুখে শুনে ‘গিরেন চোর’এর আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে কথা বলেই তথ্য সংগ্রহ করেন তিনি।
তিনি বলছিলেন, “কারও হয়তো ভারতে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার জন্য অথবা অন্য কোনও কারণে অর্থের প্রয়োজন। গিরেনকে বললেই সে গ্রামের বড়লোকদের ধানের গোলা থেকে হয়তো কয়েক বস্তা ধান চুরি করে সেই অর্থ তুলে দিল। গ্রামের মানুষ বুঝতেই পারত কার কাজ এটা। মুসলমানরা আদর করেই বলত ওই হিন্দু চোরের কাজ এটা।”
ফিরে এসে নাটকটি লিখে নাম দেন “হিন্দু চোর।”
২০১২ সালে একক অভিনয়ের এই নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় সরকারী প্রেক্ষাগৃহ শিশির মঞ্চে। তারপরেও বেশ কয়েকটি শো করেছেন তিনি।
“কখনও আপত্তি হয় নি। এবারেও নাটকের প্রদর্শনীর প্রচারের জন্য রবীন্দ্র সদন-শিশির মঞ্চ এলাকায় পোস্টার লাগিয়েছিলাম। সেই ছবি তুলেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করা হয়েছে। আমার মোবাইল নম্বরটিও পোস্টার থেকে নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর সমানে চলছে গালাগালি,” বলছিলেন মি. মণ্ডল।
শুধু যে ফোন করে বা অনলাইনে সামাজিক মাধ্যমে গালিগালাজই নয়, কলকাতা পুলিশের কাছে নাট্যকার মি মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগও করেছে হিন্দু জাগরণ সমিতি নামের একটি কট্টর হিন্দু সংগঠন।
তবে অভিযোগ জমা পড়ার আগেই সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক দেখে কলকাতা পুলিশ ওই নাটকটির পোস্টার সরিয়ে দিয়েছিল।
কলকাতা পুলিশ ফেসবুকে পোস্ট করে জানিয়েছিল “ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক একটি পোস্টার শহরের একটি জায়গায় নজরে এসেছে আমাদের। ওই পোস্টার সরিয়ে দিয়েছি আমরা। যারা ওই পোস্টার লাগিয়েছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না।”
প্রবীর মন্ডল বৃহস্পতিবার বিবিসিকে জানিয়েছেন, সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে ছয় বছর পর তার ‘হিন্দু চোর’ নাটকের নাম বদলে ‘গিরেন চোর’ করেছেন। মি. মন্ডল বলছেন, এই নাটকটিতে কোনোভাবেই হিন্দু ধর্মকে আঘাত করা হয় নি।
ফেসবুকে গালিগালাজ
ফেসবুকে বহু আক্রমণাত্মক মন্তব্য চোখে পড়ছে ওই নাটকটি নিয়ে।
অর্ণব চক্রবর্তী নামের একজন মন্তব্য করেছেন, “আমার প্রশ্ন এটা হিন্দু চোর না হয়ে **লিম চোর নাটক হতো তবে তিনি ভয় পাওয়ার জন্য জীবিত থাকতেন?”… And, you mind it Mr. Mondal… Hindus must not be taken for granted”
‘প্রতিবাদ রাণা’ নামের আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “শব্দটা হিন্দু না হয়ে …. হতো, তাহলে ঘরে ঘরে আগুন জ্বলত । হিন্দু তথা বাঙালিদের ওপর এহেন অনীহা কেন ? জাগো হিন্দু – জাগো বাংলা – জাগো বাঙালি”
সৌরভ গোস্বামী নামের আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারীর মন্তব্য “লেখকের ( প্রবীর মন্ডলের ) ফোন নং ব্যানারে দেওয়া আছে ….হিন্দুত্ববাদী ভাইবন্ধুরা একটু বুঝিয়ে বলুন ওকে- আগামীতে এরম ভুল করলে পিঠের ছাল তুলে নেওয়া হবে ।”
তবে ফেসবুকেই তার পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেকে।
তাদের একজন, ‘প্রদীপ্ত ইকারাস’ নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “নাটক সমাজের একটা দর্পন, সমাজব্যবস্থা ভালো মন্দ তুলে ধরা হয়, কখনোও সমাজকে সঠিক পথ দেখাতে চিরাচরিত সেই সমাজব্যবস্থার উপর কুঠারাঘাত করা হয়। কিন্তু বর্তমানে নাটকের উপর সরকারী কিংবা সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির হস্তক্ষেপ তাদের স্বাধীনতা খর্ব করছে। সবাইকে ভেবে দেখবার অনুরোধ রইল।”
সৌরভ শঙ্কর মুখার্জী লিখেছেন, “আমার ফ্রেন্ডলিস্টের সকলের কাছে আমার বিনিত অনুরোধ- সবাই নিচের এই নাটকটির নাম দেখেই বিক্ষিপ্ত হয়ো না। আগে নাটকটি দেখো, তারপর যা খুশি বলো।”
প্রায় উনিশ বছর ধরে গ্রুপ থিয়েটার করা প্রবীর মন্ডলের আক্ষেপ, নাটকটি না দেখেই সকলে মনে করছেন যে সেখানে বোধহয় সব হিন্দুদের চোর বলা হয়েছে।
“কোথা থেকে না ফোন করছে লোকে! দেশ তো বটেই, বিদেশ থেকেও ফোন করছে। সবাইকেই বোঝানোর চেষ্টা করছি যে নাটকটিতে কোনও ধর্মের মানুষকে চোর বলা হয় নি। একজন সহৃদয় হিন্দু ব্যক্তি, যে অন্যের উপকারের জন্য চুরি করে, তাকে নিয়েই নাটক। তবে আমি আর আমার পরিবারও এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছি। তাই নাম বদলে ‘গিরেন চোর’ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটা ফেসবুকে জানিয়েও দিয়েছি,” বলছিলেন প্রবীর মন্ডল।
Source from: http://www.bbc.com/bengali/news-44576559