ভারতের সুপ্রিম কোর্টে তিন তালাক প্রথার বিরুদ্ধে আবেদন জানিয়েছিলেন যে পাঁচজন তালাকপ্রাপ্ত নারী, তাদের মধ্যে একজন অভিযোগ করেছেন এর জন্য তাকে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে এবং তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
ওই নারী ইশরাত জাহান বলছেন ওই মামলা করার কারণে আত্মীয়স্বজন এবং পাড়াপড়শির দিক থেকে তিনি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ভারতে সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক তিন তালাক অথবা তালাক- এ-বিদ্দাত প্রথাকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে তা নিষিদ্ধ করে রায় ঘোষণা করেছিল ২২শে অগাস্ট।
ইশরাত জাহান আদতে বিহারের মেয়ে হলেও বিবাহসূত্রে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া শহরের বাসিন্দা।
ওই মামলার প্রেক্ষিতেই গত কিছুদিন ধরেই দেশ বিদেশের সংবাদমাধ্যমে তার নাম উঠে এসেছে।
কিন্তু রায় বেরনোর সপ্তাহখানেক পর থেকে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে অভিযোগ জানিয়েছেন। তিনি বলছেন প্রাক্তন স্বামীর আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া পড়শি- অনেকেই ওই মামলা করার কারণে কটু শোনাচ্ছেন ইশরাতকে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “আমার সঙ্গে খুবই দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। নানারকম কথা শোনাচ্ছেন পড়শি বা প্রাক্তন স্বামীর আত্মীয়রা। কেউ যেমন আমাকে খারাপ মহিলা বলছেন, কেউ বলছেন সুশীলা নারীরা সুপ্রিম কোর্টে বা থানায় ঘোরাঘুরি করে না বা সংবাদমাধ্যমেও আসেন না। এমনকি আমার বাচ্চাদেরও বলা হচ্ছে যে আমি ভাল মহিলা নই।”
কেউ যদি নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করে সেটা কি খারাপ কাজ? প্রশ্ন ইশরাত জাহানের।
ইশরাত হাওড়ার যে পিলখানা অঞ্চলে থাকেন, সেখানকার কিছু প্রতিবেশী সামাজিক বয়কট করারও কথা বলছেন বলেও অভিযোগ।
ইশরাতের সঙ্গেই একই ফ্ল্যাটে বাস করেন তাঁর প্রাক্তন স্বামীর বড়ভাইও। তাদের ঘরে কারেন্ট থাকলেও ইশরাতের ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে।
রাতে দুই সন্তানকে নিয়ে সেখানেই থাকেন ইশরাত। প্রাণের ঝুঁকি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ইশরাত এবং তার আইনজীবী নাজিয়া ইলাহি খান।
তাই নিরাপত্তা চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন ইশরাত।পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে লেখা ইশরাত জাহানের চিঠি
“ইশরাতকে তার পাড়া প্রতিবেশীরা কটু কথা তো শোনাচ্ছেনই, এমনকি তার হয়ে আইনী লড়াই করার জন্য সামাজিক মাধ্যমে কটু কথা শোনানো হচ্ছে আমাকেও। সিনিয়র আইনজীবীদের পরামর্শ অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিরাপত্তার আর্জি জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন ইশরাত। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে নিরাপত্তা না দেওয়া হলে বিষয়টা আমি সুপ্রীম কোর্টে জানাব,” বলছেন আইনজীবী নাজিয়া ইলাহি খান।
একদিকে যেমন নিরাপত্তা চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন ইশরাত, তেমনই প্রাক্তন স্বামীকে গ্রেপ্তার করারও আবেদন করেছেন আদালতের কাছে। তার বিরুদ্ধে ঘরোয়া নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
ইশরাতরা খবর পেয়েছেন এই সপ্তাহেই তার প্রাক্তন স্বামী দুবাই থেকে ভারতে ফিরবেন। দিল্লি বা পাটনার বিমানবন্দরেই যাতে তাকে আটক করা যায়, সেজন্যই কোর্টের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন তারা।
তার কথায়, “একটা লড়াইতে জয় হয়েছে, কিন্তু এখনও অনেকটা বাকি। প্রথমে তো প্রাক্তন স্বামীকে গ্রেপ্তার করাতে হবে, তারপরে গত তিন বছর ধরে খোরপোষ বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি – সেটা আদায় করতে হবে। আমার নিজের জন্য, সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য অর্থ তো দরকার।”
একই সঙ্গে তার মতো যেসব নারী সামাজিক চাপের মুখে পড়ে অনেক কিছু সহ্য করে নিতে বাধ্য হন – তাদেরও পাশে দাঁড়াতে চান ইশরাত।
তাদের আরও সাহস দিতেই ”কে এই ইশরত জাহান – যে এত লড়াই করার ক্ষমতা রাখে”, সেটা দেখানোর জন্য তিনি মুখের আবরণও সরিয়ে দিয়েছেন সুপ্রীম কোর্টের রায় বেরনোর পরেই। তিনি এখনও বোরকা পরেন, কিন্তু মুখ আর ঢেকে রাখতে চান না।
ইশরাতের তোলা নিরাপত্তাহীনতা আর মানসিক নির্যাতনে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলেছিলাম হাওড়ার পুলিশ কমিশনার ডি পি সিংয়ের সঙ্গে।
তিনি জানিয়েছেন, “ইশরাতের ওপরে যে মানসিক নিপীড়ন হচ্ছে, সেটা বলা হচ্ছে। বেশ কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি আমার সঙ্গে দেখা করেছে এই অভিযোগ নিয়ে। কিন্তু কে, ঠিক কী কটু কথা বলছে, বা ঠিক কীভাবে মানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে সে ব্যাপারে তিনি বা অন্য কেউ কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করেন নি। আমি কার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব? যদি এটা জানানো হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই আমি অ্যাকশন নিতে পারি।”
তবে ওই এলাকায় পুলিশের টিম কয়েক দফায় ঘুরে এসেছে বলেও জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার।