খেলোয়াড়েরা ব্রিজ খেলছেন।”>বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাস খেলাকে সহজভাবে নেয় না অনেক পরিবার। কিন্তু এটা যে জুয়া খেলা নয়, এই খেলা খেলেও যে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া যায় সেই প্রমাণ দিচ্ছেন বাংলাদেশের ব্রিজ খেলোয়াড়রা।
তাস দিয়ে খেলতে হয় ব্রিজ।
৪৩তম ব্রিজ বিশ্বকাপে এবার বাংলাদেশ অংশ নিতে যাচ্ছে।
আগামী ১২-২৬শে অগাস্ট ফ্রান্সে লিঁও শহরে অনুষ্ঠিত হবে ব্রিজ বিশ্বকাপের এই আসর।
এবারের বিশ্ব আসরে ৮টি জোন থেকে মোট ২২টি দল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। ছয় জন খেলোয়াড় ও একজন কোচসহ মোট সাত সদস্যের দল ফ্রান্স যাবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার।
বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলবেন জিয়াউল হক, আসিফুর রহমান চৌধুরী রাজিব, কামরুজ্জামান সোহাগ, রাশেদুল আহসান, মশিউর রহমান নাইম ও সাজিদ ইস্পাহানি।
এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিয়ে জোন-৪ এর যে খেলা হয়েছিল, তাতে রানার্সআপ হয়ে ব্রিজ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হয়েছে বাংলাদেশের।
বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার স্বপ্ন পূরণ
দুই বছর পরপর এই বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে তিন বার কোয়ালিফাই করতে পারেনি বাংলাদেশ দল।
এবারে বাছাইপর্বে এশিয়া অঞ্চল থেকে চারটি টিম কোয়ালিফাই করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অংশ নিচ্ছে দুটো দল – বাংলাদেশ ও ভারত।
বাছাইপর্বের খেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জিয়াউল হক বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন যে বাছাই পর্ব খেলতে দুবাই যাওয়ার ক্ষেত্রে নানারকম বাধাবিঘ্ন পার হতে হয়েছে তাদের – এমনকি ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে একজন খেলোয়াড় কামরুজ্জামান সোহাগ দলের সাথে যেতে পারেননি। দলের মূল খেলোয়াড়কে ছাড়াই পাঁচজন খেলেছেন বাছাইপর্বে।বাছাইপর্বে এশিয়া অঞ্চল থেকে বাংলাদেশ ও ভারত কোয়ালিফাই করেছে।
“শুরুর দিকে আমরা ভালো খেলছিলাম। কিন্তু একসময় আমাদের খেলা পড়ে গেল। তবে যেদিন আমাদের ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে জিততেই হবে – নয়তো আমরা কোয়ালিফাই করতে পারবো না – সেদিন জিতে আমাদের মনোবল বেড়ে গেল। এরপর আমরা ফাইনাল পর্যন্ত উঠলাম,” বলছিলেন জিয়াউল হক।
পাকিস্তান আর স্বাগতিক দুবাই এর মতো শক্তিশালী দলকে পিছনে ফেলে বাছাই পর্বে ভারত চ্যাম্পিয়ন এবং বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়ে এশিয়া অঞ্চল থেকে এই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
ওয়ার্ল্ড ব্রিজ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশ ব্রিজ ফেডারেশনের দাবি, ব্রিজ খেলার জন্য খেলোয়াড়দের অনুশীলনের কোনো জায়গা নেই – ট্রেনিংয়েরও কোনো ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে ভালো অনুশীলন করতে পারলে বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন ব্রিজ ফেডারেশনের সভাপতি মুশফিকুর রহমান।
তবে খেলোয়াড়েরা বলছেন, সামাজিকভাবেও এই খেলাটাকে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে।
‘পরিবার একটুও সহজভাবে নিতো না’
তাস দিয়ে খেলা হয় বলে ব্রিজ নিয়ে বাংলাদেশের সমাজে একটা নেতিবাচক ধারণা আছে, কারণ এখানকার মানুষ মনে করে যে তাস মানেই জুয়া।
আর এ কারণে ব্রিজ খেলতে দেখলে বেশিরভাগ পরিবারই বাধা দিয়ে থাকে, ব্রিজ খেলোয়াড়দের প্রায় প্রত্যেকেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আসিফুর রহমান চৌধুরী রাজিব যেমন বলছিলেন, “বাংলাদেশের মতো দেশে তাস খেলা ভালোভাবে দেখাই হয় না। যখন ব্রিজ খেলা শুরু করি বাসা থেকেও ভালোভাবে নেয়নি। ব্রিজ খেলতে দেখলে মনে করতো জুয়া খেলছি। সমাজের মধ্যে এ চিন্তা থাকলেও এটা কিন্তু আসলে তা নয়। ব্রিজ খেলার সাথে জুয়া খেলার কোনো সম্পর্ক নেই”।
“এই খেলাটা একেবারে আলাদা। এখানে ভাগ্যের কোনো বিষয় নেই। অন্য সব খেলার মতো ব্রিজ খেলারও একটা নিয়ম আছে, আকর্ষণ আছে। এই খেলার জন্য দরকার মেধা, হিসাব করার ক্ষমতা আর প্রখর স্মৃতিশক্তি,” বলছিলেন মি: চৌধুরী।
এই খেলার নিয়ম হলো নির্দিষ্ট কম্বিনেশনে যে সবচেয়ে ভালো খেলবে সেই ভালো স্কোর পাবে। এখানে ভালো কার্ড বা খারাপ কার্ডের কোনো বিষয় নেই।
“ব্রিজ দুনিয়ার সবচেয়ে বেশী স্বীকৃত মানসিক খেলা,” মন্তব্য একজন খেলোয়াড়ের।
তবে পার্টনার নির্ভর এই খেলার কারণে পরিবারের সহযোগিতা খুব কমই পাওয়া যায় বলে মন্তব্য খেলোয়াড়দের।
“ব্রিজ নিয়ে একটা রসিকতা আছে। আমরা যারা বাংলাদেশে খেলি আমাদের বউরা বলে, ব্রিজ খেলা হলো সতীনের মতো। তারা বলে ব্রিজের পেছনে তোমরা যেভাবে সময় দাও আমাদেরতো সেভাবে দাও না,” হাসতে হাসতে বলছিলেন জিয়াউল হক। ব্রিজ বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে ছয় সদস্যের বাংলাদেশ দল।
যারা যাচ্ছেন ব্রিজ বিশ্বকাপে
বাংলাদেশের ছয় সদস্যের ব্রিজ বিশ্বকাপ দলে আছেন, দলনেতা সাজিদ ইস্পাহানি। তিনিই বাংলাদেশ ব্রিজ দলের স্পন্সর।
তিনি ছাড়া বাকি পাঁচজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। যদিও তাঁরা একই বিভাগ ও একই বর্ষের ছাত্র ছিলেন না, কিন্তু সবাই ছিলেন শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র।
মি: নাঈম বলছিলেন, এই খেলায় ফিজিক্যাল স্ট্যাবিলিটির থেকে মেন্টাল স্ট্যাবিলিটি অনেক বেশী প্রয়োজন।
যাদের ইন্টারনেট সুবিধা আছে, তারা এ খেলায় উন্নতির অনেক সুযোগ পায়’ – বলেন জিয়াউল হক।
বাংলাদেশ ব্রিজ দলের এই খেলোয়াড়েরা ইন্টারনেটের মাধ্যমেই তাদের অনুশীলন করেন। ব্রিজ বেস অনলাইন নামে একটি সাইটে চলে তাদের অনুশীলন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিজ্ঞতা কম থাকায় শিরোপা জেতার আশা বাংলাদেশ ব্রিজ দলের না থাকলেও ভালো খেলা খেলে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠার স্বপ্ন তাঁদের সবার।
যদিও বাংলাদেশে পেশাদার ব্রিজ খেলোয়াড় নেই, তবে আর্থসামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালে এ চিত্র বদলাতে বলে মনে করেন ব্রিজ খেলোয়াড়েরা।