‘মি. ভুট্টো নিজে প্রচুর মদ্যপান করতেন, মাছ যেমন পানিতে ডুবে থাকে – তিনি তেমনি মদে ডুবে থাকতেন। কিন্তু এই মি. ভুট্টোই এ্যালকোহল নিষিদ্ধ করলেন পাকিস্তানে।’
উনিশশ’ সাতাত্তর সালের বসন্তকালে পাকিস্তানের তৎকালীন জুলফিকার আলি ভুট্টোর সরকার সেদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য মদ্যপান নিষিদ্ধ করেছিল। লক্ষ্য ছিল, তার সরকারকে টিকিয়ে রাখা এবং গোঁড়া মুসলিমদের সমর্থন পাওয়া।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি তার, ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে – আজ থেকে ৪০ বছর আগে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন তারই নিয়োগ দেয়া সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াউল হক। দু’বছর পরই মি. ভুট্টোর ফাঁসি হয় একজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার এক মামলায়।
পাকিস্তান ১৯৫৬ সাল থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হলেও ভুট্টোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে মদ্যপান একটা বৈধ এবং সাধারণ ব্যাপার ছিল ছিল। পাকিস্তানের বড় শহরগুলোয় ছিল বহু পানশালা।
রেডিও’র অনুষ্ঠানটি শুনতে পারেন এখানে:
ইতিহাসের সাক্ষী: পাকিস্তানে মদ নিষিদ্ধ হলো যেভাবে
কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পরে সেই জীবনযাত্রা একেবারেই বদলে যায়। করাচির রাশিয়ান দূতাবাসে সে সময় চাকরি করতেন শাহেদ হোসেন। তিনি নিজেও মদ পান করতেন।
বিবিসির শুমায়লা জাফরির কাছে শাহেদ হোসেন বর্ণন করেছেন, কি ভাবে সেই পরির্ব্তন এসেছিল।
১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের বড় বড় শহরগুলোতে প্রায়ই বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছিল।
বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিনকে দিন যেন আরো খারাপ হচ্ছে। দেশটির বিরোধীদলগুলোর মধ্যে ক্ষোভ ক্রমাগত আরো বাড়ছে। প্রতিনিয়তই মিছিল হচ্ছে, হরতাল হচ্ছে, প্রায়ই এসব বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে জনতার সংঘর্ষ হচ্ছে – এবং নিরাপত্তা বাহিনী শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গুলি চালাতে দ্বিধা করছে না। এতে নিহত হয় অনেকে, আহত হয় শত শত লোক, আর গ্রেফতার হয় হাজার হাজার লোক।
এসব বিক্ষোভ করছিল ইসলামপন্থী দলগুলো এবং তাদের মূল লক্ষ্য ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো।
মি. ভুট্টো তার ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতন্ত্রী রাজনীতির জন্য রক্ষণশীলদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তারা মি. ভুট্টোর বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনে এবং তার পদত্যাগের দাবি জানায়।
কিন্তু মি ভুট্টো সব অভিযোগই অস্বীকার করেন। তিনি বললেন – ‘তারা আমার যেসব সমালোচনা করছে তার কোন ভিত্তি নেই। তারা আমার রাজনৈতিক সাফল্য বা কূটনৈতিক সাফল্যের কোন সমালোচনা করতে পারছে না। তাই তারা ব্যক্তিগত আক্রমণ চালাচ্ছে।’
মি. ভুট্টো তার সরকারকে রক্ষার মরিয়া চেষ্টার অংশ হিসেবে , এবং গোঁড়া মুসলমানদের সমর্থন পাবার আশায় মদ্যপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন।
সে সময় করাচি শহরে রুশ দূতাবাসে চাকরি করতেন শাহেদ হোসেন। তিনি নিয়মিত মদ্যপান করতেন।
তিনি বলছিলেন নিষেধাজ্ঞার খবর শুনে তার কি মনে হয়েছিল।
“আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কারণ মি. ভুট্টো নিজেও প্রচুর মদ্যপান করতেন । বলা যায় মাছ যেমন পানিতে ডুবে থাকে তিনি তেমনি মদে ডুবে থাকতেন। আর সেই তিনিই কিনা এলকোহল নিষিদ্ধ করলেন।”
মদ্যপানের ওপর এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়লের পাকিস্তানের ৯৭ শতাংশ মানুষ – যারা মুসলিম। কিন্তু তা সত্বেও এই নিষেধাজ্ঞার আগ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের সময় মদ্যপান ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার।
এমনকি পাকিস্তান যখন ১৯৫৬ সালে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হলো – তখনো মদ্যপান বৈধ ছিল।
শাহেদ হোসেন বলছিলেন, করাচিতে কখনো মদ্যপান নিয়ে কোন রকম গোপনীয়তা বা নিষেধাজ্ঞা ছিল না ।
“সে সময় করাচিতে অনেক বার বা পানশালা ছিল। মেরিনা নামে একটা বার ছিল, তার সাথে আবার দুটো বইয়ের দোকানও ছিল। মদ্যপান সেসময় সংস্কৃতিরই একটা অংশ ছিল। কেউ এটা নিয়ে কিছুই মনে করতো না। এমনকি মহিলারাও মদ্যপান করতেন। এটা নিয়ে কারো কোন সংস্কার বা ঢাকঢাক-গুড়গুড় ছিল না। আসলে করাচি ছিল বহুমত-বহুপথের একটা শহর – প্লুরালিস্টিক যাকে বলে। এমনকি সমাজের অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর লোকেরাও মদ্যপান করতেন। “
“মদ তখন সস্তা ছিল। যে কেউ তখন একটা মদের দোকান দিতে পারতেন । এবং একটা বারে আপনি যতক্ষণ খুশি বসতে পারতেন।”
“মদ্যপান যে শুধু ক্যাফে এবং বারেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। পয়সাওয়ালা লোকেরা তাদের বাড়িতেই বার রাখতেন। সমাজের উচ্চশ্রেণীর পার্টিগুলোতে ওয়াইন পরিবেশন করাটা ছিল একটা আবশ্যিক ব্যাপার। বিশেষ করে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর করাচিতে।”
শাহেদ হোসেইন বলছিলেন, এমন কি যারা মদ্যপান করতেন না -তারাও ঔপনিবেশিক শাসনের ঐতিহ্যের একটা অংশ হিসেবে মদ পরিবেশন করাটাকে মেনে নিয়েছিলেন। শাহেদ হোসেনের প্রথম বারের মতো পানীয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল বালক বয়েসেই – একজন ব্রিটিশ ডাক্তারের মাধ্যমে।
“আমার মায়ের বয়েস এখন ছিয়াশি-সাতাশি হবে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, যখন আমার ছয় মাস বয়েস – তখন আমার নিউমোনিয়া হয়েছিল। তখন একজন ব্রিটিশ ডাক্তার আমাকে ব্র্যান্ডি খেতে দিয়েছিলেন। আমার মা এখনো বিশ্বাস করেন যে ওই ব্রান্ডি খাওয়ানোর জন্যেই আমি এরকম হয়েছি।”
ছাত্ররাও কি তখন মদ্যপান করতো?
“ছাত্ররা আসলে কৌতুহলের কারণে সবকিছুরই স্বাদ নিতে চায়। এটাই সেই বয়েসের ধর্ম। তবে তাদের পকেটে পানীয় কেনার মতো পয়সা থাকতো না । আমার মনে আছে ১৯৭১ সালের কথা । আমি আমার স্কুলের এক বন্ধুর বাড়িতে গেছি। বন্ধুর বাবা মা সেদিন বাড়ির বাইরে কোথাও গেছেন। আমরা সেই সুযোগে ঠিক করলাম আমরা মদ খাবো। আমরা ফ্রিজ থেকে একটা বোতল বের করলাম। আমার মনে হয়, সেটা ছিল ভদকা। তখনকার দিনে একটা খুব জনপ্রিয় গান ছিল ‘ছলকায়ে জাম’ – আমরা গ্রামোফোনে সেই গানের রেকর্ডটা চালিয়ে দিলাম। গানটা বাজছে, আর আমরা পান করছি।”
তো প্রথম সেই মদ্যপান আপনার কেমন লেগেছিল?
“আমাদের খুব ভালো লেগেছিল। বেশ নেশা হয়েছিল, খুব সুখী লাগছিল। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মদ আপনাকে একটা সুখের অনুভুতি দেয়। তবে আমি মাতাল হই নি । আসলে আমি জীবনে কখনোই মাতাল হই নি। আমার বয়েস তখন বোধ হয় সতেরো-আঠারো – বা উনিশ হবে।”
পাকিস্তানের প্রগতিশীল বামপন্থীদের চোখে মদ্যপানের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা ছিল এক চরম আঘাত। কারণ তারাই ছিলেন মি. ভুট্টোর সবচেয়ে জোরদার সমর্থক। শাহেদ হোসেন বিশ্বাস করেন , এ্যালকোহল নিষিদ্ধ করাটা পাকিস্তানে কখনোই জনপ্রিয় গণদাবি ছিল না। এটা ছিল ভুট্টোর একটা রাজনৈতিক চাল – যাতে কোন কাজ হয় নি।
এটা ছিল একটা নাটক। শতভাগ নাটক। মদ্যপান নিষিদ্ধ করতে হবে – এমন কোন দাবি তখন জনগণের মধ্যে থেকে ওঠেই নি। জনগণ তখন আন্দোলন করছে বেঁচে থাকার দাবিতে । দেশে তখন দারিদ্র্য চলছে। কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের ওপর গুলি চলছে। ভুট্টো সবাইকে অপমান করছিলেন। জনগণ তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। তিনি মনে করছিলেন আমি যদি মদ নিষিদ্ধ করি তাহলে জনগণ খুশি হবে, তারা আর আন্দোলন করবে না। কিন্তু তার হিসেব ভুল ছিল। মদ নিষিদ্ধ করে তিনি রেহাই পান নি।
এই নিষেধাজ্ঞার পরও পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা আসেনি। সহিংসতা বিশৃঙখলা চলতেই থাকলো।
উগ্রপন্থীরা বিভিন্ন জায়গায় মদের দোকানগুলোতে লাঠি আর পাথর নিয়ে আক্রমণ চালালো, ভাংচুর করতে লাগলো। লুটপাট চালাতে লাগলো।
মদ্যপান নিষিদ্ধ করার দু মাস পরই ভু্টোর সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করলেন সামরিক বাহিনীর প্রধান জিয়াউল হক। মদ্যপান এখন একটা অপরাধের পরিণত হলেও তা কখনোই সম্পূর্ণ দূর হলো না। চোরাই মদ বিক্রি ভীষণভাবে বেড়ে গেল, এবং কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে অনেকেই এ ব্যবসা্ চালিয়ে যেতে লাগলো না।
“নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর আমরা একটু সাবধান হয়ে গেলাম। কারণ পুলিশ মদের সন্ধানে যেখানে সেখানে তল্লাশি চালাতো। কেউ যদি মদ্যপানরত অবস্থায় ধরা পড়তো তাহলে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হতো এবং তার পর ঘুষের বিনিময়ে রফা হলে তাকে ছেড়ে দেয়া হতো । কারণ পুলিশের লোকেরা নিজেরাও মদ খেতো। “
শাহেদ মনে করেন, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে পাকিস্তানের সমাজে এক নতুন বিভক্তি তৈরি হয়েছে। যে করাচি ছিল সব ধরণের মত-পথের লোকের এক নগরী – তার সেই চরিত্রটিও নষ্ট হয়ে গেল।
“সমাজে একটা স্পষ্ট বিভক্তি দেখা গেল। যারা সামরিক কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকা, ক্লিফটন বা অন্যান্য অভিজাত এলাকায় থাকতেন – তারা তাদের বাড়িতেই মদ খেতে পারতেন। কিন্তু যেসব লোকেরা বস্তিতে থাকেন, তারা যে মদ কিনতে পেতেন – তা অনেক সময়ই ঠিকমত চোলাই করা হয় না, এবং এরকম মদ খেয়ে অনেকে মারা গেছেন, অনেকে অন্ধ হয়ে গেছেন। করাচিতে এক সময় অনেক বার ছিল , সেগুলো এখন অলংকার বা অন্য কোন পণ্যের দোকানে পরিণত হয়েছে। “
“পাকিস্তানের এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর যাদের জন্ম হয়েছে – সেই প্রজন্ম তাদের সংস্কৃতির অংশ হেসেবে মদ্যপানকে গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। এমনকি শাহেদ হোসেনের নিজের পরিবারের চোখেও এখন মদ্যপান হচ্ছে এমন এক পাপ – যা ক্ষমার অযোগ্য।”
“আমি কোন খারাপ লোক নই। আমি এসব মতামতকে পাত্তা দিই না। আমি জানি আমি কি। আমি আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েকে বলেছি যে আমি আবার ঘরের মধ্যে মদ্যপান শুরু করতে চাই , কারণ আমার একা লাগে। কিন্তু সে বললো, সে আমাকে এটা করতে দেবে না।”
“আমার স্ত্রীও ধর্মপ্রাণ মহিলা। আমি কখনো তার সামনে মদ্যপান করি নি। কিন্তু আমার ধারণা সে জানতো যে আমি পান করি, কিন্তু এ নিয়ে কখনো কোন কথা বলে নি। কাজেই আমার স্ত্রীকে জীবনে কখনোই বলা হয় নি, যে আমি মদ্যপান করি। সে মারা গেছে। এ নিয়ে আমার পাপবোধ আছে, আমি নিজেকে অপরাধী মনে করি।”
পাকিস্তানে মদ্যপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা এখনো অব্যাহত আছে। শাহেদ হোসেন এখনো করাচিতেই বাস করেন।
তিনি এখন আর মদ্যপান করেন না।