
ভারতে মেয়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি তিনমাস থেকে বাড়িয়ে ছ’মাস করার জন্য গত বছর যে আইন পাস হয়েছে, তা আসলেই কোনও কাজে আসছে কি না – তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক ।
টিমলিজ সার্ভিসেস নামে একটি সংস্থার করা সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, এই নতুন আইন চালু হওয়ার পর মেয়েদের চাকরি দিতে অনেক কোম্পানিই দ্বিধায় ভুগছে – এমন কী এই অর্থ বছরের শেষে ১৮ লক্ষ নারী চাকরি হারাতে পারেন বলেও জানানো হয়েছে।
শ্রমিক সংগঠনগুলি এবং বহু কর্মরত মা-ই অবশ্য মনে করছেন, ছ’মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি অনেক লড়াইয়ের পর অর্জিত একটি অধিকার – কোনও যুক্তিতেই তা কমানোর চেষ্টা মেনে নেওয়া যায় না।
বস্তুত ভারতে মাতৃত্বকালীন ছুটি দ্বিগুণ করে গত বছরের জুলাই থেকে যে নতুন আইন বলবৎ হয়েছে, ততটা সুযোগ সুবিধা নরওয়ে ও কানাডা ছাড়া অন্য কোনও পশ্চিমা দেশেও নেই।
নতুন আইনে বলা হয়েছে, দশের বেশি কর্মী কাজ করেন এমন যে কোনও সংস্থা তাদের মহিলা কর্মীদের প্রথম দুই সন্তান প্রসবের সময় ছমাসের সবেতন ছুটি দিতে বাধ্য থাকবেন।
কিন্তু এই আইন চালু হওয়ার ফলে বহু সেক্টরেই মেয়েদের চাকরির সুযোগ সঙ্কুচিত হচ্ছে, বলছিলেন টিমলিজ সার্ভিসেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী।
তিনি জানাচ্ছেন, “টিমলিজের জরিপ বলছে এভিয়েশন, শিক্ষা, রিটেল, ব্যাঙ্কিং ও আর্থিক খাত, রিয়েল এস্টেট বা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মতো অনেক খাতেই দেখা যাচ্ছে কোম্পানিগুলি বাড়তি খরচের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন – আর মেয়েদের নিয়োগ করার ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়ছে।”
“বড় মাপের বা পেশাদারদের দিয়ে চালানো কোম্পানিগুলো এই বাড়তি চাপ সামলে নিলেও ছোট বা মাঝারি সংস্থা, কিংবা স্টার্ট-আপগুলো এতে সমস্যায় পড়ছে।”
তবে মায়েদের জন্য এই ছমাসের ছুটি যে খুবই ইতিবাচক ফল দিচ্ছে – টিমলিজ সে কথাও মানছে।
ভারতে মাতৃত্বকালীন ছুটি যখন মাত্র তিন মাসের ছিল, সে সময় মা-হওয়ার পর কর্পোরেট সংস্থার উঁচু পদের চাকরি ছাড়তে হয়েছিল নেহা চোপড়াকে। ছমাসের ছুটি থাকলে তার কেরিয়ার গ্রাফই হয়তো অন্যরকম হত, মনে করেন মিস চোপড়া।
তিনি বলছিলেন, “আমি তিন মাসের ওই ছুটি নিইনি, কারণ আমার জন্য ওটা যথেষ্ট হত না। আমার শিশুকে আমি বুকের দুধ খাওয়াতে চেয়েছিলাম, লম্বা ছুটি পেলে অবসাদের সঙ্গে যুদ্ধ করাটাও অনেক সহজ হত।”
“ফলে আমি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে আমি পাশাপাশি এটাও বিশ্বাস করি শুধু মা নন – এই লম্বা ছুটিটা যদি বাবা-মার মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়া যেত, সেটা আরও অনেক ভাল হত।”
আবার ভারতে বৃহত্তম শ্রমিক সংগঠন সিটু-র সাধারণ সম্পাদক তপন সেনের সন্দেহ, এই সব জরিপের আড়ালে আসলে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে কাটছাঁট করার একটা কর্পোরেট ষড়যন্ত্র চলছে।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “এই সব কোম্পানিগুলোর লাভ করার যেন একটাই রাস্তা, মেয়েদের মেটারনিটি বেনিফিট-টা তুলে দেওয়া। টিমলিজের মতো কোম্পানিগুলো কর্পোরেটের দালাল হিসেবে কাজ করে, তারা তো এই ধরনের যুক্তিই দেবে!”
“কিন্তু আমরা পরিষ্কার বলতে চাই, মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার অনেক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে অর্জিত – এর সঙ্গে কোনও আপস চলবে না। এই বেনিফিট থাকলে মেয়েদের রিক্রুট করা যাবে না, কোনও সভ্য সমাজ কি এই যুক্তি দিতে পারে না কি?”
অ্যাক্টিভিস্ট ইন্দ্রানী মালকানিও মনে করেন, এত লম্বা মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য ভারতের কর্পোরেট জগত হয়তো এখনও প্রস্তুত নয় – কিন্তু তাহলেও কিছু করার নেই।
তার যুক্তিটা হল, “মেয়েদের পেশাগত জীবনে মাতৃত্বটাকে কিছুতেই বাধা হতে দেওয়া যায় না। পেশাদার মহিলাদের কি বাচ্চাকাচ্চা হবে না নাকি? মায়ের সঙ্গে তার বন্ধন গড়ে তোলার জন্য শিশুর জীবনের প্রথম ছ’মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ – ফলে এই ছুটিটা তাকে দিতেই হবে।”
ফলে ছমাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য ভারতে এখনও দাবী খুবই জোরালো সন্দেহ নেই – কিন্তু কর্পোরেট দুনিয়া থেকে ধীরে ধীরে এই আওয়াজটাও উঠতে শুরু করেছে যে এতে আসলে মেয়েদের নাকি হিতে বিপরীতই হচ্ছে, কারণ বাড়তি খরচের ভয়ে অনেক কোম্পানিই মেয়েদের চাকরি দিতেই ভয় পাচ্ছে।
বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
বিবিসির চোখে: কেমন হলো গাজীপুরের নির্বাচন
‘ব্রাজিলের খেলা দিনের পর দিন পরিণত হচ্ছে’
ম্যারাডোনা মধ্যাঙ্গুলি কাকে দেখালেন, কেন?
Source from: http://www.bbc.com/bengali/news-44631306