দেওয়ালিতে বাজি বন্ধের নির্দেশ: কী বলছে মানুষ?

Date:

Share post:

দেওয়ালির রাত বাচ্চাদের আনন্দ ফূর্তির রাত’- মন্তব্য অভিভাবকদের

বায়ু দূষণ কমাতে ভারতের অনেক শহরেই এবারে হিন্দুদের দেওয়ালি উৎসবের সময় আতসবাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ করেছে আদালত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন শীতের মরসুম শুরুর আগে আতসবাজি থেকে নির্গত ধোঁয়া অনেকদিন ধরে সাংঘাতিক দূষণ সৃষ্টি করে। সে কারণেই এই ব্যবস্থা।

কিন্তু আদালতের এই পদক্ষেপে অনেকে ক্ষুব্ধ, কারণ আতসবাজি ফাটিয়ে এই একটি দিন আলোর উৎসব পালন করাটা দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য- একটা ট্র্যাডিশন।

হিন্দুদের বড় উৎসব দীপাবলী বা দেওয়ালি আর বাঙালি হিন্দুদের কালীপুজো- এই উৎসবের একটা অঙ্গ যেমন ধর্মীয় রীতি মেনে পুজো অর্চনা, অন্য এবং বড় অঙ্গটি হল আতসবাজি পোড়ানো।

কিন্তু আতসবাজি যেসব উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়, তা থেকে যে মারাত্মক বায়ু এবং শব্দদূষণ হয়, সে কথা পরিবেশবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন। দেওয়ালির সময়ে শ্বাসকষ্ট বা ফুসফুসের রোগাক্রান্তদের অবস্থা যে আরও কাহিল হয়, সেটাও বলছেন চিকিৎসকরা।

এতদিন বিভিন্ন রাজ্যে বাজী থেকে তৈরি হওয়া দূষণ নিয়ন্ত্রণের নানা ব্যবস্থা হলেও এবারই দেশের সর্বোচ্চ আদালত বেশ কড়া একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজধানী দিল্লি আর পার্শ্ববর্তী জাতীয় রাজধানী অঞ্চলে বাজি বিক্রি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে আদালত।দেওয়ালিতে আতসবাজি ফাটানো দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য

পূর্ব দিল্লির বাসিন্দা, স্কুল শিক্ষিকা কাকলি রায় বলছেন আদালতের এই রায়ের ফলে তার বা পরিবারের ছোটদের মন খারাপ।

মিসেস রায়ের কথায়, “মন একটু হয়তো খারাপ, কিন্তু দেওয়ালির সময়ে যে পরিমাণে দূষণ ছড়ায় সেটা তো সাংঘাতিক। আমাদের স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যেই একটা সমীক্ষা করে দেখেছি যে দেওয়ালীর ঠিক পরেই বাচ্চাদের নিশ্বাসের সমস্যা, চোখের সমস্যা এমনকি চোখের সমস্যাও বেড়ে যায় অনেক গুণ। আমরা তাই বাচ্চাদের বাজি না পোড়াতেই শেখাই। ছোটরা যদিও বা বোঝে, কিন্তু উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করাটা একটু কঠিন হয়।”

মিসেস রায়ের স্বামী কল্যাণ রায় একটি দৈনিক খবরের কাগজের সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি অবশ্য বলছেন যে বাজি থেকে যে দূষণ ছড়ায়, তার থেকেও অনেক বেশি দূষণসৃষ্টির উৎস রয়েছে দিল্লি আর আশপাশের এলাকায়।

“বাজি থেকে যে দূষণ ছড়ায়, তা নিয়ে দ্বিমত নেই। তবে সেটা তো কয়েকদিনের মধ্যে দূরও হয়ে যায়। বাজির থেকেও অনেক বেশি ক্ষতিকারক এবং গুরুত্বপূর্ণ দূষণের উৎস আছে দিল্লি আর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ না করে একটা নী-জার্ক রিঅ্যাকশন কি ঠিক? এটা তো আলোর উৎসব – বাচ্চারা একটা সন্ধ্যায় একটু আনন্দ করবে – এটাই তো দেখে আসছি চিরকাল!” বলছিলেন কল্যাণ রায়।

তবে দিল্লি লাগোয়া হরিয়ানার অত্যাধুনিক শহর গুরগাঁওয়ের বাসিন্দা দেবযানীর কথায় তার শিশু সন্তানকে দেওয়ালীর পরে যে কষ্ট সহ্য করতে হয়, তার জন্য বাজি বন্ধ হওয়ার পক্ষেই তিনি।

“বাজি পোড়ানোর পরের কদিন যে অবস্থা হয়, তাতে আমার মতো অনেক মা-ই বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পান। বিকেলে পার্কে খেলাধুলো বা অন্য কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই নেই। তাই আমি তো মনে করি বাজি বন্ধ করে ঠিকই হয়েছে,” বলছিলেন দেবযানী।বাজি থেকে যে দূষণ ছড়ায়, তা নিয়ে দ্বিমত নেই।

একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত মৃণাল কান্তি দাস আবার দূষণ ছাড়াও বাজি বন্ধের অন্য একটি ভাল ফলের দিকে ইঙ্গিত করলেন।

তিনি বলছিলেন, “এই বাজি শিল্পের সঙ্গে এত শিশু শ্রমিক জড়িত থাকে, যেটা বেআইনী। অনেক বাচ্চাই বাজি কারখানায় কাজ করতে গিয়ে মারা যায়। বাজি বিক্রি যদি বন্ধ হয়, অন্তত এই বাচ্চাগুলিকে বিপজ্জনক কাজে কিছুটা হলেও হয়তো কম লাগাবে কারখানা মালিকরা।”

সুপ্রিম কোর্ট যেমন বাজি বিক্রিতে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তেমনই পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট বলেছে দেওয়ালির সন্ধ্যেবেলা মাত্র তিনঘন্টা বাজি পোড়ানো যাবে। আবার বম্বে হাইকোর্ট জানিয়েছে আবাসিক এলাকাগুলিতে বাজি বিক্রি করা যাবে না। আদতে কলকাতার বাসিন্দা, কিন্তু এবার দেওয়ালিটা মুম্বাইতেই কাটাবেন অয়ন চক্রবর্তী।

তিনি বলছিলেন, “বায়ু আর শব্দ দূষণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের যুক্তি না মানার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু এটাও তো ঘটনা শব্দবাজি যদি নাও পোড়াই, আলোর বাজি পুড়িয়ে বাচ্চা থেকে আমরা বুড়োরা – সবাই তো একটা দিনই আনন্দ করি। একটা সামাজিক উৎসবও বটে মুম্বাইতে এটা। ভাল হতো যদি একটা কোনও মধ্য পন্থা বার করা যেত – যাতে দূষণ নিয়ন্ত্রণও হবে, আবার আমাদের এই নির্মল আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হতে হবে না।”

বাজি থেকে তৈরি হওয়া দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। শীর্ষ আদালতের রায়ের পরে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কি ভাবনা চিন্তা করছে এরাজ্যেও বাজি বন্ধের বিষয়ে?

পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলছেন শব্দ বাজির সীমা বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারে তার রাজ্যই পথিকৃত।

”সেই দাবি করলেও, কিন্তু এটা বলতে পারব না যে সেটা সম্পূর্ণ বন্ধ করা গেছে। এখনও কালী পুজোর সময়ে শব্দদূষণের মাত্রা অন্য সময়ের গড় থেকে বেশ বেড়ে যায়, দূষিত বায়ুকণার পরিমাণও পরিবেশে অনেক বেশি থাকে। কিন্তু আমাদের যেহেতু কিছু নিয়মের মধ্যে চলতে হয়, তাই এখনই বাজি নিষিদ্ধ করাটা সম্ভব না, যদি না কোনও আদালত নির্দেশ দেয়। তবে আমরা যেটা করছি, তা হল স্কুল, আবাসিক কলোনি, পুলিশ- এদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছি যাতে সব ধরণের বাজি ব্যবহারই সাধারণ মানুষ বন্ধ করেন। এই দূষণ এমন জিনিষ, যা নবজাতক থেকে প্রবীণতম ব্যক্তি সকলেরই ক্ষতি হয়। সেটাই প্রচার করার চেষ্টা করছি আমরা,” বলছিলেন অধ্যাপক রুদ্র।

দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যদিও বলছে যে তারা শুধু বাজি বিরোধী প্রচারের ওপরেই জোর দিচ্ছে, অন্যদিকে কিছু পরিবেশবিদ ভাবনা চিন্তা করছেন পশ্চিমবঙ্গেও যাতে বাজির ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায় দিল্লির মতো, তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানাবেন তারা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আবারো এস আলমে আগুন 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় এস আলম গ্রুপের চিনির গুদামের পর এবার তেলের মিলে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের...

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...