এ আর রুহুল আমিন হাজারী
কুমিল্লা প্রতিনিধিঃ
কুমিল্লার দেবীদ্বারে একটি আবাসিক ফ্ল্যাট থেকে তাছলিমা আক্তার(৪০) নামে এক গৃহবধূর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
নিহত তাছলিমা মুরাদনগর উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের হোসেন মিয়ার কণ্যা এবং দেবীদ্বার উপজেলার ওয়াহেদপুর গ্রামের আব্দুস সালামের পুত্র মো. রবিউল্লাহ(৩৫)’র দ্বিতীয় স্ত্রী এবং রবিউল তাছলিমার তৃতীয় স্বামী। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাছলিমার স্বামী রবিউল্লাহকে আটক করেছে।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে পৌরসভার গোমতী আবাসিক এলাকার পূর্ববানিয়াপাড়া গ্রামের সাবেক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হাজী মো. আব্দুল ওয়াহেদ’র মালিকানাধীন ২৮/১নং বাড়ি ‘পুষ্পকুঞ্জ’র ৪র্থ তলার পূর্বপাশের ফ্ল্যাট থেকে ওই গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
লাশ উদ্ধার হওয়ার সময় নিহতার পরনে সেলোয়ার, কামিজ ও খয়েরি রং এর বোখড়া ছিল, তাছলিমা তখন উপুড় হয়ে ও মাথাগুঁজা অবস্থায় দেহের অর্ধেক খাটে ও পা’গুলো মেঝেতে পড়েছিল, পায়ের অংশে প্রচুর রক্তক্ষরণের চিহ্ন ছিল। আত্মহত্যার চিহ্ন হিসেবে মরদেহের বরাবর উপরে ফ্যানের সাথে বাঁধা একটি সাদা ওড়নাও ছিল। ওই মহিলার মোবাইল সেট, স্বামীর ব্যবহার্য্য বস্ত্র, কাগজপত্র সহ বিভিন্ন সামগ্রী আলামত হিসাবে জব্দ করেছে পুলিশ। তবে পুলিশের ধারনা একাধিক ব্যক্তি তাকে খাটের উপর উপুর করে মাথা চেঁপে, শ্বাসরোধ ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করতে পারে।
তবে এটি আত্মহত্যা নয়, দাবী করে- এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এটি পরিকল্পিত এবং একটি সংঘবদ্ধ কিলারগ্রæপের দ্বারা শ্বাসরোধে ও ছুরিকাঘাতে সংগঠিত হত্যাকান্ড হতে পারে।
তবে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা দেবীদ্বার থানার উপ-পরিদর্শক (এস,আই) মো. ওমর ফারুক বলেন, নিহতার ফ্লাট থেকে উদ্ধার করা আলামতের মধ্যে মোবাইল ফোনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ, ওই মোবাইল ফোনের সূত্রধরে রাত দেড়টায় নিহতার বাপের বাড়ি মুরাদনগর উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের বাড়ি থেকে তার স্বামী রবিউল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। একই সময় ছোরতহাল রিপোর্ট তৈরীপূর্বক নিহতার মরদেহও থানায় নিয়ে আসা হয়। আটক রবিউল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে, অদ্য সকাল ১১টায় নিহতার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরন করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এমূহুর্তে কোন তথ্য দেয়া যাবেনা এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পরই গৃহবধূ হত্যা- নাকি আত্মহত্যা করেছে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এর আগে ফ্ল্যাটটির বাহির থেকে তালাবদ্ধ ছিলো বলে জানায় পুলিশ ও বাড়ির মালিক। বাড়ির মালিকের মেয়ে চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া ইউপি সদস্য মোসা. জেসমিন আক্তার জানান, বৃহস্পতিবার ইফতারের পর ৪র্থ তলা থেকে মরদেহের দুর্গন্ধ পেয়ে পুলিশকে খবর দিলে দেবীদ্বার থানার উপ-পরিদর্শক(এস,আই) মো. ফারুক’র নেতৃত্বে একদল পুলিশ এসে ফ্লাটের তালা ভেঙ্গে খাটের ওপর থেকে ওই নারীর মরদেহটি উদ্ধার করে।
বাড়ির মালিকের ছেলে মো. শাহাদাত হোসেন জানান, বাড়িতে টু-লেট দেখে চলতি মাসের ১৮ তারিখ স্বামী রবিউল্লাহ(৩৫)-স্ত্রী তাছলিমা(৪০) ও ৬ বছর বয়সী এক পুত্র সন্তান নিয়ে বাড়ির ৪র্থ তলার এ ফ্ল্যাটটি ৫হাজার ৫শত টাকায় ভাড়া নেন। এরই মধ্যে ভাড়া নেয়া ৩ কক্ষের ফ্লাটের ২টি কক্ষে দু’টি খাট, আলনা ও কিছু তৈজস সামগ্রী নিয়ে আসে এবং গোছিয়ে বাসাটি পরিপাটি করে রাখে। ভাড়াটিয়া পুরুষটি জানান, সে কুমিল্লায় জব করেন, তাদের বাড়ি মুরাদনগর উপজেলায়। ভাড়া নেয়ার সময় (ভোটার) এনআইডি কার্ড ও অগ্রিম টাকা চাওয়ায়, একটি এনআইডি কার্ড দেখিয়ে বলে এটি ফটোকপি করে আগামীকাল (২০ এপ্রিল) অগ্রিম টাকা সহ দিয়ে যাওয়ার কথা বলে উধাউ হয়ে যায় এবং মোবাইলের সংযােগও বন্ধ করে রাখে।
পরে ২০ এপ্রিল পুনরায় ০১৩১০০৩৩৭২৮ সেল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে (ভোটার) এনআইডি কার্ড চাওয়ায় বিকালে দিবে বলেন ওই নারীর স্বামী জানালেও এর পর থেকে মোবাইল ফোনটি বন্ধ পায় এবং তাদের ফ্ল্যাটটিও তালাবদ্ধ দেখতে পান। অজ্ঞাত কোন কারনে তারা কৌশলে নাম পরিচয় গোপন রেখেছিল বলে ধারনা পোষণ করেন তিনি। এরই মধ্যে ৩/৪ দিন যাবৎ অন্যান্য ফ্লাটের ভাড়াটিয়ারা দূর্গন্ধ পাওয়ার অভিযোগ করলেও কোন ক্লু পাননি। বৃহস্পতিবার ইফতারের পর অসহনীয় পঁচা গন্ধ পাওয়ায় পাশ^বর্তী ফøাটের তালা ভেঙ্গে ওই মহিলার মর দেহ দেখতে পেয়ে আবার তালাবন্ধি করে পুলিশকে খবর দেন।
খবর পেয়ে দেবীদ্বার-ব্রাহ্মণপাড়া সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আমিরুল্লাহ, দেবীদ্বার থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মেজবাহ উদ্দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। রাতেই পিবিআই ও সিআইডির দু’টি টিম আসে। তারা রাতেই উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোন ট্রেক করে নিহত গৃহবধূর পরিচয় পান এবং রাতেই ওই মহিলার স্বামী দেবীদ্বার উপজেলার ওয়াহেদপুর গ্রামের রবিউল্লাহকে তার শ^শুরবাড়ি মুরাদনগর উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রাম থেকে আটক সহ রাত দেড়টায় নিহতার মরদেহ সহ থানায় নিয়ে আসেন পুলিশ।
স্থানীয়রা জানান, তাছলিমার পূর্বে আরো ২টি বিয়ে হয়েছিল, ওই দুই সংসারের ২ পুত্র ও বর্তমান সংসারে ৭ মাস বয়সী সাকিল নামে এক পুত্র রয়েছে। প্রায় ২২বছর পূর্বে প্রথম বিয়ে হয়েছিল মুরাদনগর উপজেলার থোল্লা গ্রামের সিএনজি চালক রবিউল’র সাথে। তার প্রথম স্বামী রবিউল মদ, গাঁজা খেয়ে তাছলিমার উপর খুব অত্যাচার চালাত, এক পর্যায়ে সাগর নামে এক পুত্র সন্তান থাকা সত্বেও তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পুত্র সাগর বর্তমানে কাতার প্রবাসী। প্রায় ৭/৮ বছর পূর্বে দ্বিতীয় বিয়ে হয় একই উপজেলার দিলালপুর গ্রামের দুবাই প্রবাসী মনির হোসেন’র সাথে, এ সংসারে রাফি নামে ৬ বছরের এক পুত্র সন্তান রয়েছে। এ বিয়েটাও বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। প্রায় ৩ বছর পূর্বে দেবীদ্বার উপজেলার ওয়াহেদপুর গ্রামের আঃ সালাম’র পুত্র সিএনজি চালক রবিউল্লাহর সাথে পরকিয়ার সংবাদে মনির হোসেন তাকে তালাক দিয়ে দেয়। তালাকের এক বছর পর রবিউলের সাথে তাছলিমার বিয়ে হয়। তাদের এ সংসারেও সাকিল নামে ৭ মাসের আরো এক পুত্র সন্তান রয়েছে।
একই ধারায় পথ চলা দেবীদ্বার উপজেলার ওয়াহেদপুর গ্রামের আঃ সালামের পুত্র রবিউল্লাহ(৩৫)’র বিরুদ্ধেও একই ধারায় পথ চলা দেবীদ্বার উপজেলার ওয়াহেদপুর গ্রামের আঃ সালামের পুত্র রবিউল্লাহ(৩৫)’র বিরুদ্ধেও একাধিক বিয়ে করার অভিযোগ রয়েছে। রবিউল্লাহ প্রায় ১৮বছর পূর্বে নিজ গ্রামের নজরুল ইসলামের কণ্যা লিপি আক্তারকে বিয়ে করেন। তাদের পারভেজ(১৬), রাসেল(১৩) ও সাগর(১০) নামে ৩ পুত্র সন্তান রয়েছে।
নিহত তাছলিমার ছোটভাই মো. সজিবুর রহমান বলেন, রাতে পুলিশের ফোন পেয়েই সে তার বোনের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন। তার বোন জামাই রবিউল্লাহ তাদের দুই শিশু পুত্রকে নিয়ে তাদের বাড়িতেই আছেন। গত ২০ এপ্রিল থেকে আমার বোন নিখোঁজ হয়েছে বলে তার বোন জামাই জানিয়েছিল। তখন মুরাদনগর মধ্যপাড়া টাওয়ারের সাথে ভাড়া বাসায় থাকত।
সজিব আরো জানান, কুয়েত প্রবাসী ভাগিনা সাগর বাড়ি করার জন্য পাঠানো নগদ টাকা ও স্বর্নালঙ্কার আত্মসাতের জন্যই রবিউল পরিকল্পিতভাবে নাম ঠিকানা ছাড়াই দেবীদ্বারে বাসা ভাড়া নিয়ে তার বোনকে হত্যা করে এখানে লোকিয়ে রেখে নিখোঁজ নাটকের আড়ালে আমাদের বাড়িতেই অবস্থান করছিল। এরই মধ্যে একাধিকবার মুরাদনগর ও দেবীদ্বার থানায় সাধারন ডায়েরী করার কথা বললেও কোথাও ডায়েরী করেনি।
কুয়েত প্রবাসী আমার ভাগিনা সোহাগ তার মায়ের মাধ্যমে মুরাদনগর উপজেলার ছবিনগর গ্রামে কিছু জমি ক্রয় করে ওখানে বাড়ি নির্মানের পরিকল্পনা নেয়। গত ২০ এপ্রিল দিলালপুর ওই জমিতে বাড়ি নির্মানের জন্য সকাল ৭টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত মাপঝোপ হয়েছে। ওই সময় বোন আমার সাথেই ছিল, তার পর আর তাকে পাওয়া যায়নি। আমাদের ধারনা বাড়ি নির্মানের টাকা আত্মসাৎ করতেই আমার বোনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফুর রহমান জানান, লাশ উদ্ধার পূর্বক মর্গে প্রেরন করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিহতের স্বামী রবিউল্লাকে আটক করা হয়েছে, তার সহযোগীতায় শুক্রবার বিকেল পৌনে ৪টায় আরো একজন আটক করা হয়েছে। এ হত্যাকান্ডের সাথে আর কেউ জড়িত আছে কি না তা নিশ্চিত হতে তাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চলছে। নিহতার ভাই ও বাবা যে কেউ মামলা করলে আমরা মামলা নেব।