ঢাকায় গত দু-তিন মাসে মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রাদুর্ভাব এক বিরাট স্বাস্থ্য সংকটের সৃষ্টি করেছে। বহু মানুষ এ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন যারা এখনো ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।
ঢাকা মেডিকেলে গত সপ্তাহেই ছশোরও বেশি রোগি চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা নিয়েছেন। গত দুই মাসে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের মতো।
স্থানীয় পত্রপত্রিকার খবরে এবং অনেকেই আশঙ্কা করছেন ঢাকার ঘরে ঘরে যেভাবে এ রোগ ছড়িয়েছে তাতে কয়েক লক্ষ মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
গুলশানের আব্দুল্লাহ আল ফাহাদ তার আক্রান্ত মাকে নিয়ে এসেছিলেন মহাখালীর রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে।
সেখানে তিনি বিবিসিকে বলেন, তাদের চার সদস্যের পরিবারে তিনি নিজে-সহ তিনজন চিকুনগুনিয়ায় ভুগেছেন।
তার ভাষায় “এটা মহামারী আকার ধারণ করছে। এটা সব ঘরে ঘরে দেখা যাইতেছে। আমার বন্ধুবান্ধব বলেন, কমবেশি সবার ফ্যামিলিতেই কেউ না কেউ আক্রান্ত।”
ঢাকার কলাবাগান এলাকার একটি দোতলা ও টিনসেড বাড়িতে শ্রমজীবী ৮-১০টি পরিবারের বসবাস। গত দুই মাসে ওই বাড়ির শিশু-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় সবাই এ কঠিন জ্বরে ভুগেছেন।
আর চিকুনগুনিয়া জ্বর এসব নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায়ও বড় প্রভাব ফেলেছে।
দোতলা বাড়ীর ভাড়াটিয়া নাজমা বেগম ভুগছেন এখনো। জ্বর কমেছে তবে সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না, কাজকর্মেও যেতে পারছেন না আগের মতো।
বললেন, মানুষের বাড়ীতে কাজ করে তার সংসার চলে। চারদিন কামাই দিয়েছেন এখন ব্যথায় শক্তি দিয়ে কাজ করতে পারছেন না। তিনদিন গেলে একদিন কামাই দেন।
একই বাড়ীর নিচতলার আরেক পুরুষ জানান চালক হিসেবে তিনি যে চাকরি করে সংসার চালাতেন সেটি হারিয়েছেন চিকুনগুনিয়ার জন্য।
জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৫দিন অনুপস্থিত থাকতে হয়েছে। যাবার পর চাকুরিদাতা বলেছেন অন্য ড্রাইভার নেয়া হয়েছে।
ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট জানাচ্ছে এবছর মে মাসের পর থেকে ঢাকায় চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এটাকে তারা মহামারী হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান না।
প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, “সার্ভেতে দেখা গেছে ৫০টা সাইটের মধ্যে ৪৭টা সাইটেই কিন্তু মশার পরিমাণ এমন পর্যায়ে আছে যেখান থেকে চিকুনগুনিয়া ডেঙ্গু হতে পারে ঝুকিপূর্ণ যেটাকে বলি।”
“তার মানে আমি যেটা বলতে চাই, এডিস মশার দৃষ্টিকোন থেকে ঢাকা শহরের সব জায়গাতেই এটার সম্ভাবনা রয়ে গেছে এবং আমরা রোগ কিন্তু সব জায়গা থেকেই পেয়েছি।”
রাজধানী ঢাকা ছাড়াও পাশ্ববর্তী এলাকা এবং গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, গোপালগঞ্জ, নরসিংদী ও রাজশাহী জেলাতে ১৯ জুলাই পর্যন্ত নিশ্চিত চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ২৪ জন রোগী সনাক্ত হয়েছে।
তবে আইইডিসিআর-এর পরিচালক বলছেন, “যদিও ঢাকার বাইরে থেকে রিপোর্ট এসেছে কিন্তু তারা ঢাকা শহরে এসেছিলেন এবং ঢাকা থেকে গেছেন। সুতরাং এটা এরাও ঢাকা থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি। তাই ঢাকার বাইরে ছড়িয়েছে এ কথাটা আমরা এখনও বলতে পারছি না।”
চিকুনগুনিয়া জ্বরের একমাত্র বাহক এডিস মশা। যেহেতু চিকুনগুনিয়ার কোনো টিকা বা চিকিৎসা নেই তাই মশার বংশবিস্তার রোধ আর জনসচেতনতাই চিকুনগুনিয়ার প্রতিরোধ ও প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর পূর্বশর্ত।
তাই ভুক্তভোগীরা সবাই মনে করছেন মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কর্পরোশনেরই ব্যপক অবহেলা ছিল। মশা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে পরে তিনি দুঃখ প্রকাশও করেছেন।
এ পরিস্থিতির কারণ নিয়ে দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাইদ খোকন বলেন, “চিকুনগুনিয়া সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মতো আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। এ রোগটা সম্পর্কে আমরা একেবারেই পরিচিত ছিলাম না।”
“আর এই রোগটা যখন শুরু হলো তখন আমাদের সর্বাত্মক প্রস্তুতিটুকুও ছিল না। মাঝখানে রমজান মাসও চলছিল। সবকিছু মিলিয়ে আপনি দুর্বলতা বলতেই পারেন।”
মি. খোকন বলেন, ” বিষয়টি আমাদের অনেকটা অপ্রত্যাশিত ছিল। যাই হোক যেটা হবার সেটা হয়ে গেছে, পেছনের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। আশাবাদ ব্যক্ত করছি এটা তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।”
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে ঢাকায় সিটি কর্পোরেশনগুলোর তৎপরতা এখন অনেকটা দৃশ্যমান। যদিও এতদিনে বিপুল সংখ্যক মানুষ রোগযন্ত্রণায় ভুগেছেন আর জ্বর সারলেও কষ্ট পাচ্ছেন আক্রান্তদের অনেকেই।
পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক আব্দুল মতিন ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার এবারের প্রকোপকে মহামারী হিসেবেই আখ্যায়িত করেন।
তার কথায়, “ডেফিনিটলি এটা একটা মহামারী ছিল, মহামারী আছে এখনো। এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে। মহামারী মানে অনেক লোক মারা যাবে তা না। এটা মানুষের একটা ভুল ধারণা আছে। মহামারী হচ্ছে যে জিনিসটা একটা পরিমাণে ছিল সেটা হঠাৎ করে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।”
“এটাতে মানুষ মরলো কি মরলো না সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। তারা বলেছেন কোনো রোগীতো মরে নাই, এটা মহামারী হয় কী করে? তার মানে সরকারকে খুশী করার জন্য তারা টেলিভিশনে বড় বড় কথা বলছেন কিন্তু বেসিক মহামারীর যে এপিডেমিক সূত্র সেটা ভুলে গেছেন বলে মনে হয়।”
মি মতিন চিকুনগুনিয়ার এ ব্যাপক প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে সচেতন না থাকা সিটি কর্পোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগসহ কর্তৃপক্ষের সার্বিক ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছেন।
“মেয়রদেরকে, জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সরকারকে প্রোঅ্যাকটিভ হতে হবে। তাহলে মানুষ এ দুর্গতি থেকে মুক্তি পাবে।”
“মানুষের যে অভিযোগ সরকারের কাছে বা আকাঙ্ক্ষা আছে সেটা হলো-আপনি যেহেতু আমাদের ভোটে নেতার পর্যায়ে বসেছেন, আপনি এটার জন্য যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন, আপনি মানুষকে উপদেশ দিচ্ছেন কিন্তু আপনি নিজের দায়িত্ব পালন করছেন না – মানুষ এটা মানতে রাজি নয়!”
আমাদের পেজে আরও পড়তে পারেন :
ভারতের নতুন রাষ্ট্রপতি সম্বন্ধে দশটি অজানা তথ্য