টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা

Date:

Share post:

তখন স্কুলে পড়তাম।দ্বিতীয় নিাকি তৃতীয় শ্রেণিতে। মায়ের মুখে শুনেছিলাম খোকার গল্প। তখন মনে হয়েছিল নেহাতই কোন এক রুপকথার গল্প। এমন ান মানুষ কি থাকতে পারে? মনে মনে ভাবতাম এসব। যখন ৬ষ্ঠ,৭ম ক্লাসের গণ্ডি পেরুলাম ,বুঝতে পারলাম সেটা গল্প ছিলনা,তিনি ছিলেন আমাদের খোকা।
খোকার নাম বঙ্গবন্ধু । ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মছিলেন এই মহামানব। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা শেখ সায়েরা খাতুন। লুৎফর-সায়েরা দম্পতির সন্তান।
শেখ লুৎফর রহমান এবং সায়েরা খাতুনের আদরের খোকা, টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। স্কুল জীবন থেকে তিনি বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে লাগলেন। যখন একটু বড় হলেন, নেতা হয়ে ঠলেন; তখন বুঝতে পারলেন বাংলার মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায় পাকিস্তানিদের বিতাড়ন। তখন মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি ছুটে বেড়ান বাংলার আনাচে-কানাচে, পথে-প্রান্তরে। এ সময়ে শহর-বন্দর, গ্রাম-বাংলার মানুষ তাকে নেক নামে ডেকেছে। এর মধ্যে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল ‘মুজিব ভাই’।
১৯৬৬ সাল থেকে তার নামের আগে তরুণ সমাজ ‘সিংহশার্দূল’, ‘বঙ্গশার্দূল’ ইত্যাদি খেতাব জুড়ে দিতে থাকে। তবে ‘মুজিব ভাই’, ‘শেখের বেটা’, ‘বাংলার মুজিব’, ‘শেখ মুজিব’, ‘বঙ্গশার্দূল’, ‘সিংহশার্দূল’- এ সব ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলার বন্ধু। বাংলাদেশের মানুষের বন্ধু। আর সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’। এ উপাধি তিনি এমনি এমনি পাননি। এর পিছনে রয়েছে সংগ্রামমুখর ইতিহাস।

পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র সব সময়ে তাকে ঘিরে রেখেছিলো। সংগ্রাম-আন্দোলনে বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে শেখ মুজিবুর রহমানকে বহুবার কারাগারে পাঠায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একের পর এক মিথ্যা মামলা। তেমনই একটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।

১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় অভিযোগ আনে- শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং কয়েকজন সাধারণ সৈনিক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। সবাইকে পাকিস্তানি সরকার গ্রেপ্তার করে।

প্রাণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের পর ফুঁসে ওঠে বাংলার মানুষ। তৎকালীন শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রাজপথে নামে -জনতা। উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ। আন্দোলনের দাবানল দেখে আঁতকে ওঠে স্বৈরাচারের চেয়ার। মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী।

১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে খ্যাত ৬ দফার কারণে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে ফাঁসি দেওয়ার লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয়। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ১৯৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু কার্যালয়ে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ১১ দফা কর্মসূচি করে।

তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘৬ দফা দাবিতে একটিও অন্যায়, অসংগত, পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। … তথাপি কায়েমি স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছে।’

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষের খাদেম বা সেবক হিসেবে ‘তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সাধনায়’ নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। ৬ দফার বক্তব্য জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করতে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জেলায় করেন। এই জনসভায় প্রচুর জনসমাগম হয়। আইয়ুবের তাবেদার গভর্নর মোনায়েম খান তার সভাসমাবেশে বলেন, ‘শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছেন।’

বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার কোনো কোনো অংশ আপত্তিকর- গোয়েন্দাদের দিয়ে এমন রিপোর্ট করিয়ে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হতে থাকে। এক জনসভার মামলায় জামিন নিতে না নিতে আরেক জেলায় মামলা করা হয়। সরকারের এই প্রতিহিংসামূলক তৎপরতায় বাংলার মানুষের সমর্থন বঙ্গবন্ধুর দিকে যায়। তাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তীব্রতা পায়। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও আইয়ুব সরকারের পতনের লক্ষ্যে ছাত্র-যুব--পেশাজীবীদের দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়। ওই মামলা থেকে শেখ মুজিব তের রায়ে মুক্তি পাননি। বাংলার মানুষ তাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে শত্রুর থাবা থেকে ছিনিয়ে আনে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ওই দিনই সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ তাকে রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনা দেয়। সেখানে তাকে যে অভিধায় সম্বোধন করা হয়, আজ তা তার নামের অংশ, ‘বঙ্গবন্ধু’।

বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের অভূতপূর্ব সফলতা, আইয়ুব খানের পতন ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজনৈতিক বন্দির নিঃশর্ত মুক্তিকে স্মরণীয় রাখার জন্য ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হয় জনসভার।
জনসভায় এত লোক সমাগম হয়েছিল যে, তা শেষ পর্যন্ত জনসমুদ্রে রূপ নেয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমেদ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ভূষিত করেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে।
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এক জনসভায় শেখ মুজিব সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হবার আহ্বান জানান। পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সর্বাত্মক হামলা চালালে শুরু হয় বাংলাদেশের নয় মাস ব্যাপী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম।
শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হলো। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২-এর দশই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করুন : জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ

ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক ও আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অধিকৃত ফিলিস্তিনি...

ইরানে হামলায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিও জড়িত: রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত

যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলি আক্রমণকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছিল। তাই তাদের...

ইউক্রেনে বড় ধরনের হামলা করল রাশিয়া

ইউক্রেনে বেশ বড় ধরনের ড্রোন হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। ২০২২ সালে আগ্রাসন শুরুর পর এটাই ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড়...

ইরানের ওপর আবারও আঘাত হানল যুক্তরাষ্ট্র!

টানা ১২ দিনের তীব্র সংঘাত শেষে এই মূহুর্তে যুদ্ধবিরতি চলছে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে। এই সংঘাতের শেষ দিকে ইসরায়েলের পক্ষ...