সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বকে বিচারের আহবান জানিয়ে দেওয়া জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন মিয়ানমার প্রত্যাখ্যান করেছে।
মিয়ানমারে সরকারের একজন মুখপাত্র জ তে বলেছেন, ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে’, সেটি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
চীনও এই প্রতিবেদন বাতিল করে দিয়ে বলেছে, মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করা হলে সেটি সঙ্কট সমাধানে ‘সহায়ক হবে না।’
সরকারি মুখপাত্র জ তে এক বিবৃতিতে বলেছেন, মিয়ানমারের সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কখনোই সহ্য করে না।
গত সোমবার জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। তার দু’দিন পর মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে এভাবেই তার জবাব দেওয়া হলো।
“জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের কর্মকর্তাদেরকে আমরা মিয়ানমারে আসতে দেই নি। আর সেকারণে মানবাধিকার পরিষদের তৈরি যে কোন প্রস্তাবের সাথে আমরা একমত হতে পারছি না,” রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইট অফ মিয়ানমারকে একথা বলেছেন জ তে।
তিনি বলেছেন, “জাতিসংঘের সংস্থা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেসব মিথ্যা অভিযোগ এনেছে” সেগুলো তদন্ত করে দেখার জন্যে তাদের নিজেদেরই একটি স্বাধীন কমিশন রয়েছে।
এর আগেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা শুধু জঙ্গি সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহীদের ওপর অভিযান পরিচালনা করছে।
মিয়ানমারের সাথে যে দেশটির ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে সেই চীনও বলেছে, “ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং জাতিগতভাবে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি খুবই জটিল।”
“শুধুমাত্র মিয়ানমারের সমালোচনা করলে কিম্বা এবিষয়ে দেশটির উপর চাপ প্রয়োগ করলে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তা সহায়ক হবে না,” বলেছেন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র হুয়া চুনিং।
গত বছরের অগাস্ট মাসে মিয়ানমারে পুলিশের কয়েকটি চৌকিতে জঙ্গি হামলার পর সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে অভিযান চালাতে শুরু করে এবং তারপর থেকে বাংলাদেশে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। নিহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ।
এই অভিযানের সময় ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও অভিযোগ উঠেছে যার মধ্যে রয়েছে হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং বাড়িঘর ও জমিজমায় অগ্নিসংযোগ।
মিয়ানমার সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে অবৈধ অভিবাসী যারা দেশটির নিরাপত্তা এবং বৌদ্ধদের আত্মপরিচয়ের জন্যে বড় ধরনের হুমকি।
জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে সামরিক বাহিনীর ছ’জন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছেন সেনাপ্রধান মিন অং লাইংও। জেনারেলদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাদের বিচারেরও দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘ।
‘ফেসবুকই ইন্টারনেট’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেরও কড়া সমালোচনা করেছেন মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র। কারণ জাতিসংঘের রিপোর্টটি যেদিন প্রকাশ করা হয় সেদিনই ফেসবুক কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারে সামরিক কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সংস্থার ২০টি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়। মুছে দেওয়া হয় ৫২টি ফেসবুক পেজ।
মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে এসব অ্যাকউন্ট ও পেজ বন্ধ করে দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। তবে তারা এটাও স্বীকার করেছে যে এই কাজ করতে তাদের খুব দেরি হয়ে গেছে।
ফেসবুকে কোন দেশের সামরিক কর্মকর্তা কিম্বা রাজনীতিকের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার ঘটনা এটাই প্রথম।
কিন্তু সরকারি মুখপাত্র জ তে বলছেন, ফেসবুকের এসব পরিকল্পনার ব্যাপারে তাদের সরকার অবহিত নয়।
“ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন আছে। কেন তারা এসব নিষিদ্ধ করেছে এবং সেগুলো আমরা কিভাবে পুনরুদ্ধার করতে পারি?” জানতে চান তিনি।
তবে তিনি জাতিসংঘের এই বক্তব্যের সাথে একমত যে “বেশিরভাগ ব্যবহারকারীর কাছে ফেসবুকই হচ্ছে ইন্টারনেট।”
জ তে আরো জানিয়েছেন, ফেসবুকের সিদ্ধান্ত নিয়ে মিয়ানমার সরকার ফেসবুকের কাছে জানতে চেয়েছে। তিনি এও বলেন যে এবিষয়ে সরকার ও ফেসবুকের মধ্যে একটি সমঝোতার কাজ চলছে।
মিয়ানমারে সবচেয়ে বৃহৎ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এই ফেসবুক। পৌনে দু’কোটিরও মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন।
নিরাপত্তা পরিষদেও আলোচনা
জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনটির প্রকাশিত হওয়ার দু’দিন পর সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত নিকি হেলি বলেছেন, সঙ্কটের এক বছর পর জাতিসংঘ কী ধরনের উদ্যোগ নেয় সেটা দেখতে সারা বিশ্ব জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
মিয়ানমারের দূত বলেছেন, সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। আর চীনা দূত সঙ্কট সমাধানে আরো কূটনৈতিক উদ্যোগের উপর জোর দিয়েছেন।