ছবির গলায় মালা। সামনে প্রদীপ জ্বলছে। চারপাশে পোস্টার, আলোকচিত্র সাজানো। নাটক, সেমিনার, কর্মীদের ব্যস্ততা। সবখানে মানুষের প্রাণবন্ত উপস্থিতি। গতকাল শুক্রবার বহুজনের কণ্ঠে সচকিত জাতীয় নাট্যশালার পরিবেশ। কেবল তিনি শুধু নীরব। ছবির মানুষটি। তিনি সেলিম আল দীন। তাঁর অনুরাগীরা মনে করেন, রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা নাটকের নতুন পথের দিশারি তিনি।
সেলিম আল দীন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মফিজউদ্দিন আহমেদ ও মা ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান সেলিম আল দীন। প্রথম লেখাপড়ার শুরু আখাউড়ায় গৃহশিক্ষকের কাছে। কিছুদিন পর সেনেরখিল প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। তারপর মৌলভীবাজারের বড়লেখার সিংহগ্রাম হাইস্কুল, কুড়িগ্রামের উলিপুরে মহারাণী স্বর্ণময়ী প্রাইমারি স্কুল এবং রংপুর ও লালমনিরহাটের স্কুলে পড়েন। পরে নিজ গ্রাম সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৪ সালে। ফেনী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। টাঙ্গাইলের সাদত কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নেন। এরপর ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপি রাইটার হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করলেও পরে বাকি জীবন শিক্ষকতাই করেছেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।
২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় মারা যান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁকে সমাহিত করা হয়। যদি এমনটি না ঘটত, যদি তিনি বেঁচে থাকতেন; আজ শনিবার ১৮ আগস্ট ৭০-এ পা রাখতেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই জন্মদিনের উৎসব হতো। কিন্তু নিয়তি তাঁকে ছুঁতে দেয়নি ৭০ সংখ্যাটি; তিনি নেই। না থাকার শূন্যতাকে মেনেই জয়ন্তীর আয়োজন করেছে ঢাকা থিয়েটার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও স্বপ্নদল। গতকাল ১৭ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে দুই দিনের আয়োজন। আজ শনিবার দ্বিতীয় দিন সকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা থেকে বাসে করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা করেছেন তাঁর অনুরাগীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পুরোনো কলাভবন থেকে নাট্যাচার্যের সমাধি অভিমুখে স্মরণ-শোভাযাত্রা ও পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন তাঁরা। সন্ধ্যা সাতটায় পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে স্বপ্নদলের প্রযোজনা, জাহিদ রিপনের নির্দেশনায় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের কালজয়ী সৃষ্টি ‘হরগজ’-এর মঞ্চায়ন।
গতকাল এবং আজ তাঁর কাছের মানুষদের বর্ণনায় নানাভাবে বারবার এসেছেন সেলিম আল দীন। আসলে শিল্প-সাহিত্যের পথপরিক্রমায় তিনি হেঁটেছেন আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের পথ ধরে। হাজার বছরের বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন সমকালীন শিল্প নন্দনে। হাজার বছরের বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্যের বিকাশের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেন তিনি। সেলিম আল দীন বাংলার গ্রামগঞ্জে পালা, জারি, যাত্রাগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন গভীরভাবে। নানা আঙ্গিককে তুলে এনে সমকালীন বৈশ্বিক রুচিবোধের অনুকূলে উপস্থাপন করেছেন। বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে রচনারীতিসহ সামগ্রিকতায় তিনি বাঙালির বহমান রীতিকেই গ্রহণ করেছিলেন।
সহপাঠী বন্ধুদের চাপে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তহল নাট্য প্রতিযোগিতার জন্য প্রথম নাটক লেখেন। নাটকই হয়ে ওঠে তাঁর পথ চলার প্রধান বাহন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর নাটক লেখার ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সেলিম আল দীন নিজস্ব এক নাট্যরীতির অনুসন্ধান চালিয়ে যান। তবে নাট্যকার হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত হলেও শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর ছিল স্বচ্ছন্দ পদচারণ। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ গবেষণা নানা ক্ষেত্রেই তাঁর ঐতিহ্যবিকাশী প্রবণতাই প্রধানরূপে লক্ষণীয়। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি গান লেখা শুরু করেন। নাটকের গান তো ছিলই। পাশাপাশি আরও অনেক গান লিখেছিলেন। তিনি গানকে বলতেন, কথা সুর।
তার রচিত নাটকগুলোর প্রথম পর্যায়ে নিরীক্ষা থাকলেও পরবর্তী রচনাগুলোর সবই বাঙলার নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির রূপে পরিপুষ্ট। ঐতিহ্যকে গ্রহণ করেছেন বলে তিনি অতীতে বাস করেননি।
নাটক লেখার শুরুর দিকে তিনি বাংলার প্রান্তিক মানুষের জীবন ও সংগ্রামের চিত্র বর্ণনা করেছেন। ‘করিম বাওয়ালির শত্রু’ অথবা ‘মূল মুখ’ দেখা নাটকে মৌচাকের মধু সংগ্রহের পেশানির্ভর জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে। তেমনি ‘আতর আলীদের নীলাভ পাট’ নাটকের মধ্যে সেলিম আল দীন এ দেশের জনসমাজের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। চাষিদের সংগ্রাম, মহাজনী প্রথাসহ প্রান্তিক জীবনের নানা বিষয় তাঁর এ নাটকে বিদ্যমান।
‘শকুন্তলা’ নাটকে প্রাচীন বাঙালিত্বের স্বাদ পেয়েছে দর্শক। বাঙালির ‘মেলা’ সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে সেলিম আল দীন রচনা করেছেন ‘কীর্তনখোলা’ নাটক। সংস্কৃতির নানা দিক এতে ফুটে উঠেছে। যেখানে সেলিম আল দীন মূলত হাজার বছরের বহমান বাংলা সংস্কৃতির গভীর পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষা করেছেন। ‘কীর্তনখোলা’ নাটকের শুরুতেই অষ্টাদশ শতকের বাঙলার জনপ্রিয় ‘দেওয়ানা মদিনা’ পালার বন্দনার নিরিখে বন্দনা করেছেন।
বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যযুগের সুপরিচিত ধারা মঙ্গলকাব্য। মাঙ্গলিক চিন্তন বিন্যাসের রূপায়ণ তার ‘কেরামতমঙ্গল’ নাটক। কেরামতের জীবনপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এ নাটকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সমাজ, সভ্যতা ও বাস্তবতাকে।
সমুদ্র উপকূলবর্তী আঞ্চলিক মানুষের জীবনচিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর ‘হাত হদাই’ নাটক। এ নাটকে বাংলার আঞ্চলিক জীবন ফুটে উঠেছে। সেলিম আল দীনের কথা নাট্যরীতির আরেকটি নিরীক্ষাধর্মী ‘যৈবতী কন্যার মন’। এ নাটকেও তিনি ঔপনিবেশিক সাহিত্যধারাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যধারাকে বিকশিত করেছেন
‘চাকা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৪ সালে এবং ‘কীর্তনখোলা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ২০০০ সালে। ‘একাত্তরের যীশু’ চলচিত্রের সংলাপ রচনা করেন ১৯৯৪ সালে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পর সেলিম আল দীনের উদ্যোগেই ১৯৮৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৪; একুশে পদক, ২০০৭; জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, ১৯৯৩; অন্য থিয়েটার (কলকাতা কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা) ; নান্দিকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ, কলকাতা) ১৯৯৪; শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার, ১৯৯৪; খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার; জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার (‘একাত্তরের যীশু’, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) ১৯৯৪; মুনীর চৌধুরী সম্মাননা, ২০০৫ সহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
১৯৭৪ সালে সেলিম আল দীনের সঙ্গে বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার বিয়ে হয়। একমাত্র সন্তান মঈনুল হাসানের অকালমৃত্যুর পর থেকে সেলিম আল দীন ছিলেন নিঃসন্তান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে যেই মানুষ অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি, তিনি হচ্ছেন সেলিম আল দীন। বিভিন্ন উৎসবের মূল বাণী ঠিক করে দেওয়া, অনুষ্ঠানের আমেজ অনুযায়ী গান তৈরি করাসহ সবই করতেন। সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মাটিতেই অনন্তকালের জন্য ঘুমিয়ে আছেন।
সেলিম আল দীন জীবনকে যেমন করে চিনেছিলেন, মৃত্যুকেও তেমনিভাবে চিনতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি নাটকে তিনি কোনো এক অধরা পৃথিবীর অচিনলোকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন; সেলিম আল দীন হাসতে হাসতে মানবজীবনের কঠিন সত্যকে তুলে ধরতে পারতেন। বেঁচে থাকতে যেমন করে নতুন কিছু করার সদা তৎপরতায় বিভোর থাকতেন, মৃত্যুটাও তাঁর তেমনই। যেমন গতকাল সন্ধ্যায় ‘ধাবমান’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয় জাতীয় নাট্যশালায়। এ নাটকে এক স্থানে তিনি লিখেছেন ‘সে মৃত্যু কষ্টজয়ী হোক, সে দুঃখ জয়ী হোক/ শোক পারায়ে যাক সবল পায়ে…।’ তেমনি করেই সবল পায়ে শোক পেরিয়ে তার আদর্শ ও চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে জন্মদিনের উৎসবে শামিল হয়েছে সুহৃদ ও অনুজেরা।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন সমবেত সবাই সেলিম আল দীনের জয়ন্তী উপলক্ষে, তখন তিনি অনতিক্রমণীয় দূরত্বে। তিনি কী দেখছিলেন ছেড়ে যাওয়া সঙ্গী ও অনুরাগীরা কী গভীর শ্রদ্ধা আর নিখাদ ভালোবাসায় স্মরণে রেখেছে তাঁকে? এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই।