বিবিসির চোখে: কেমন হলো বাংলাদেশে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন

Date:

Share post:

নারী-পুরুষ উভয় ভোটারের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো
Image caption নারী-পুরুষ উভয় ভোটারের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো

বুধবার সকালে গাজীপুরে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে ফলাফল নেয়ার সময় শত শত সমর্থক বেষ্টিত মি: আলম ছিলেন উচ্ছ্বসিত। বলেছেন, ভোটারদের তি তিনি কৃতজ্ঞ।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী মি: আলম দুই লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন বিরোধীদল বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে ।

কিন্তু এই নির্বাচন নিয়ে তাকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, এবং প্রশ্নগুলো সহসা তার পিছু ছাড়বে না।

জাহাঙ্গীর আলমের সাথে আমি যখন কথা বলছিলাম, তার বক্তব্য ছিল, “আপনারা অনেক প্রশ্ন তুলছেন। একটা বড় নির্বাচন হলে কিছু অনিয়ম হয়। এই নির্বাচনেও কিছু অনিয়ম হয়েছে বলেই নির্বাচন কমিশন নয়টি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করেছে। কিন্তু সেটা পুরো নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে পারে না। এখানে নির্বাচন শতভাগই সুষ্ঠু হয়েছে।”

কিন্তু তার এই বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার মিল কতটা?

ভোটের দিনে অর্থাৎ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটায় আমি টঙ্গী বাজারের কাছে গাছা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখি ভোটারের দীর্ঘ সারি। অনেক নারী পুরুষ। কেন্দ্রের চত্বরে পরিবেশও ছিল বেশ ভাল।

কিন্তু কেন্দ্রের ভেতরে গুলোতে গিয়ে দেখা যায় – বিএনপির মেয়র প্রার্থীর কোনো এজেন্ট নেই।

প্রশ্ন তুললে অন্য এজেন্টরা আমাকে জবাব দিলেন, “তারা বাথরুমে গেছেন, এখনই চলে আসবেন।”

ঘন্টাখানেক ঐ কেন্দ্রে ছিলাম, সেই সময়েও বিএনপির এজেন্টরা বাথরুম থেকে ফিরে আসেননি।

অল্প দূরত্বেই আরেকটি ভোটকেন্দ্র কলেমেশ্বর িক বিদ্যালয়ে গিয়ে একই রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই।

তবে ঐ কেন্দ্রটিতে বাড়তি একটা দৃশ্য চোখে পড়ে, তাহলো কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভিড়। তারা তাদের প্রতীকের ব্যাজ লাগিয়ে তাদের নির্বাচনী ক্যাম্পে এবং বাইরে সক্রিয় রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে কেন্দ্রের ভিতরে গিয়েও ঘুরে আসছেন।

কেন্দ্রের চত্বর এবং ভেতর যে তাদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল, তা বুঝতে কষ্ট হয়নি।

টঙ্গী এবং গাজীপুরের দশটি ভোটকেন্দ্র আমি ঘুরেছি। তার মাত্র একটি কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট পেয়েছিলাম। সেই এজেন্টকেও তার প্রার্থীর ব্যাজ বা পরিচয়পত্র লাগাতে দেখা যায়নি। তিনি জানান, ভয়ে কোনো ব্যাজ ব্যবহার করছেন না।

গাজীপুর মোড়ে জটলা করে থাকা কিছু লোকজনের সাথে আমি কথা তারা নিজেদের বিএনপি মেয়র প্রার্থীর সমর্থক বলে পরিচয় দিলেন।

তাদেরও বক্তব্য ছিল, ভয়ে তারা তাদের প্রার্থীর ব্যাজ লাগাননি।

আমি যে ক’টি কেন্দ্র দেখেছি, বেশিরভাগ কেন্দ্রেই বাইরে এবং ভিতরে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

Image caption নৌকায় সিল মারা ব্যালট পেপার, িনাতুল উলুম আলিম ে কেন্দ্র

ভোটারদের দীর্ঘ সারি

সকালের দিকে অধিকাংশ কেন্দ্রেই ছিল ভোটারদের দীর্ঘ সারি।

তাদের অনেকে বলেছেন, অনেকদিন পর নিজের ভোট দিয়ে তারা আনন্দিত।

কিন্তু কেন্দ্রের বাইরে এবং ভিতরে ছিল আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ।

এরমধ্যেই কোনাবাড়ি এলাকায় একটি িদ্যালয় কেন্দ্রে একজন যুবকের দেখা মেলে। তিনি নৌকার ব্যাজ পরে এসে ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন।

এই যুবক আমার সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে তার ভোট দেয়ার গল্পটি বলে দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়েন।

চারশ’ পঁচিশটি কেন্দ্রের মধ্যে আমি দশটি কেন্দ্র ঘুরেছি। একে নির্বাচনের সার্বিক চিত্র হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু ঢাকার যেসব সাংবাদিক এই নির্বাচন দেখতে গিয়েছিলেন, তাদের অভিজ্ঞতাও ছিল কমবেশি আমার মতই।

ভোট শেষে একজন সাংবাদিক মন্তব্য করেন, “ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি এবং দৃশ্যমান পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় ছিলনা কোথাও কিছু সমস্যা ছিল।”

Image caption বুথ থেকে বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে এক বিএনপি কর্মীর অবস্থান ধর্মঘট, শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র

ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল

া ১১টার দিকে হঠাৎ একটি কেন্দ্র থেকে একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট আমাকে ফোন করে বললেন, “আপনি কোথায়, এই কেন্দ্রে সিল মারছে দ্রুত আসেন।”

তিনি আমার মোবাইল ফোন নাম্বার কোথায় পেয়েছেন, তা আর জানা হয়নি।

দ্রুত সেই এম এ আরিফ কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখি, নৌকা মার্কার ব্যাজ লাগানো কয়েকজন যুবক বুথ থেকে বেরিয়ে গেলেন।

তবে তাদের সিল মারা দু’একটি ব্যালটের প্রমাণ সেখানে রয়ে যায়।

কেন্দ্রের একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট অভিযোগ করলেন, ঐ যুবকরা বুথের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে অন্য কক্ষে গিয়ে নৌকা মার্কায় এবং আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরেছে।

সেখানে বাইরে তখনও ভোটারের সারি। এক ঘণ্টা ভোট বন্ধ থাকার পর আবার ভোটাররা ভোট দিতে পারেন।

এই কেন্দ্রের সাথেই একটি প্রাইমারি স্কুলের বুথেও একই অভিযোগ পাওয় যায়।

অবশ্য নির্বাচন কমিশন পরে এই দু’টি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করে।

গাজীপুর শহরে মদিনাতুল উলুম আলিম মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে ভোটার উপস্থিতি দেখে পরিবেশ দেখে ভালই মনে হয়েছিল।

কিন্তু এই কেন্দ্রের তিনতলায় গিয়ে দেখা যায়, দুই তিনজন যুবক প্রকাশ্যে নৌকা মার্কায় সিল মেরে সেই ব্যালট বাক্সে ভরছেন।

বিবিসির সারোয়ার হোসেন ক্যামেরা তাক করার সাথে সাথে তারা দ্রুত কাজ সেরে সরে পড়েন। সবার সামনে এমন ঘটনা অবাক করার মতো।

ঐ কেন্দ্রে সবকটি বুথে একটি ঘটনা ঘটে।

এমন পরিস্থিতিতে সেখানে ভোট বন্ধ থাকার অনেকটা সময় পর আবার ভোট নেয়া হয়। মাদ্রাসাটিতে চারটি কেন্দ্র ছিল। একটির ভোট পরে বাতিল করা হয়।

ভোটের পরে গাজীপুরের রাস্তায় কয়েকজন ভোটারের সাথে কথা বলি।

তাদের একজন বলছিলেন, “বড় মারামারি বা কাটাকাটি নাই। তারপরও এই নির্বাচন নিয়ে আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে… কৌশলে খেলা হয়েছে।”

তবে সেখানে কথায় কথায় বেসরকারি হাইস্কুলের একজন শিক্ষক আমাকে প্রশ্ন করলেন, নির্বাচন কী প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছে?

আপনার কী মনে হয়? আমার পাল্টা প্রশ্নে ঐ শিক্ষকই বললেন – ধরপাকড়ের ভয়ে বিএনপি নেতা-কর্মিরা মাঠে ছিল না। ভোটের দিনও তারা সংগঠিত এবং সক্রিয় ছিল না। ফলে নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী দিয়ে অংশ নিলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো না বলে তিনি মনে করেন।

Source from: http://www.bbc.com/bengali/news-44629051

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

তালাক দেওয়া স্ত্রীকে ১৭ দিন আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ

ঝালকাঠির নলছিটিতে তালাক দেওয়ার পর সাবেক স্ত্রীকে ১৭ দিন আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে গোলাম রাব্বি নামে এক...

২৩ মিনিটে তুর্কমেনিস্তানের জালে বাংলাদেশের ছয় গোল

এশিয়া কাপের জায়গা আগেই নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। আজ বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে...

ভুলবশত নিজেদের ছোড়া গুলিতে ৩১ ইসরায়েলি সেনা নিহত: রিপোর্ট

গাজা উপত্যকায় আগ্রাসন চালাতে গিয়ে ভুলবশত নিজেদের ছোড়া গুলিতে (ফ্রেন্ডলি ফায়ার) কমপক্ষে ৩১ জন ইসরায়েলি দখলদার সেনা নিহত...

৪ আগস্ট ছাত্রদের পক্ষে ঢাল হয়ে দাঁড়ানো সেই মাসুদ এখন রমনার ডিসি

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট। সারাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাজপথে নামে লাখো মানুষ, শিক্ষার্থী,...