এক ফালি চাঁদ কিংবা এক টুকরো কেকের গল্প : মাহবুবুল হক শাকিল

Date:

Share post:

মেয়েটা ঘুমিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এখনো তার কপালে জলপট্টি। দুপুরে অনেক কষ্ট করে খাওয়াতে পেরেছে জাউভাত আর ডিমের ঝোল। কাল সকাল থেকেই মেয়েটার জ্বর। সন্ধ্যার পর থেকে শরীর গনগনে কাঠকয়লার আগুনের মতো গরম ছিল। সারা রাত সে মেয়ের শিয়রে। জ্বরের ঘোরে মেয়েটা কতই না আবোল-তাবোল বকেছে। সে শুধু তার জানা কয়েকটি সূরা বারবার পড়েছে আর মেয়ের বাবাকে কিছুক্ষণ পর পর অভিশাপ দিয়েছে। মেয়েটা জ্বরের ঘোরে কতকিছু খাওয়ার আবদার করেছে। একবার বলে পোলাও-কোরমা খাবে তো আবার বলে উঠে, মা, আইসক্রিম খাব। গতকাল দুপুরের রান্না করা ভাত আর ঘন মুসুরের ডাল ছিল ঘরে। মেয়ের মুখে দু লোকমা দেওয়ার পরেই সে বমি করে দেয়। তারপর শুধু চিনি গোলানো পানি। লেবুও ছিল না ঘরে, শরবত করে দেওয়ার মতো। ভোরের দিকে জ্বর কিছুটা কমার পর মা আর মেয়ে দুজনেই ঘুমায়। ঘুমের ভেতরে সে স্বপ্ন দেখে, সুখকর কিছু নয়, তার জীবনের প্রতিটি দিনের মতো সেইসব স্বপ্ন শুধুই দুঃস্বপ্নের গল্প নিয়ে আসে।
সকালে সে মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। মগবাজার রেললাইনের পাশে তাদের বস্তির কাছেই বাজার। সেই বাজারের একমাত্র ফার্মেসিতে ডাক্তার বসে। লোকটার মুখ, কুঁচকানো ভুরু আর ঠোঁটে অনবরত জ্বলতে থাকা সিগারেট দেখে মনে হয় সে সমস্ত জগত-সংসারের প্রতি কোনো কারণে ভীষণ বিরক্ত হয়ে আছে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়েই সে বাচ্চাটিকে দেখে। তারপর নাম আর বয়স জিজ্ঞেস করে প্রেসক্রিপশন লেখে।
এই ওষুধগুলা খাইতে থাকুক। তিন দিন পর আবার নিয়া আসবা। রক্ত পরীক্ষা করতে অইবো। তারপর বুঝা যাইবো ডেঙ্গু না টাইফয়েড।
তার বুকটা ধড়াস করে কেঁপে ওঠে। সে শুনেছে ডেঙ্গু হলে নাকি অনেক সময় মানুষ বাঁচে না। এক অজানা শংকায় হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। তার কান্নায় ডাক্তারের মুখের বিরক্তির পর্দা অনেকটা সরে যায়।
আরে! ভোদাইয়ের মতো কান্দো ক্যান? আমি কি কইছি নাকি যে ডেঙ্গু অইসে? রক্ত পরীক্ষা করলে কইতে পারুম। অহন ওষুধগুলা নিয়ম কইরা খাওয়াইয়া যাও আর ভালামন্দ খাওন দেও। দেইখ্যা তো মনে অয় শইলে রক্ত নাই। হের বাপে কৈ?

একথার কোনো জবাব দেয় না সে। আঁচলে চোখ মুছে সোনালি রঙের প্রায় ছেঁড়া ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করে ডাক্তারের দিকে একটা পুরোনো এক শ’ টাকার নোট বের করে দেয়। এটাই তার ভিজিট। ডাক্তার নোটখানা টেবিলের ড্রয়ারে রাখে, মুখে আবারও ভর করে বিরক্তির ছায়া। কম্পাউন্ডারের কাছ থেকে ওষুধ কিনে সে পা বাড়ায় ঘরের দিকে, হাতের আঙুলে জড়িয়ে থাকে মেয়ের জ্বরতপ্ত ছোট্ট হাত।
মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর পর সে খেতে বসে। পাতিলে ভাত আছে, আজকের রান্না করা। তবু সে হাত বাড়ায় মিটসেফে, গতকালের পান্তা ভাত নামাতে। দুপুরের ভাতটুকু মেয়ে রাতে খাবে, আরেকটি ডিম আছে রান্না করা, তা দিয়ে। সে পান্তা ভাতে পিয়াজ আর কাঁচামরিচ ডলে এক লোকমা ভাত মুখে নেয়।

এই পারুল কী করস ? ময়নার শইল এখন কেমুন?
হেনা যখন দরজায় আসে তখন তার খাওয়া শেষ। সে হেনাকে ভেতরে আসতে বলে।
বুঝতাসি না। জ্বর তো খালি যায় আহে। অহন একটু বালা।
তাইলে রেডি অ। আইজকা কিন্তু মহরত। কানা শমসের কইসে তোরে লইয়া যাইতে। বালা রোল দিবো।
নামটা কানে আসতেই তার সমস্ত গা ঘৃণায় গুলে ওঠে। লোকটার তাকানোটাই ভয়ংকর, শরীর শিউরে ওঠার মতো। অনেক দিনই সে আভাসে-ইঙ্গিতে পারুলকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে। সে তাতে সাড়া দেয় নি, বরং যতটা পারে শমসেরের কাছ থেকে দূরে দূরে থেকেছে। হেনা অবশ্য অত-শত গায়ে মাখে না। তার কথা হলো, নাচতে যখন নেমেছি তখন ঘোমটা দেব কেন? ঘোমটা অবশ্য পারুলও দেয় না, কারণ এই লাইনে কাজ করলে ঘোমটা দেওয়া চলে না। তবে শমসেরকে সে কেন যেন সহ্যই করতে পারে না। লোকটার একটা চোখ কানা। কিন্তু আরেকটা চোখে সারাক্ষণ লালা ঝরতে থাকে মেয়েছেলের শরীর দেখলেই। এটা তাদের মধ্যে প্রায় সবাই জানে। জানার পরও শমসেরকে না করা সম্ভব হয় না। কারণ, সে প্রোডাকশন ম্যানেজার। পারুল বা হেনার মতো যারা এফডিসিতে একস্ট্রার কাজ করে তারা জানে, কানা শমসেরের ক্ষমতা কতটা। প্রযোজক বা পরিচালকরা নায়ক-নায়িকা বা বড় চরিত্রের আর্টিস্টদের কাস্ট করেন। কিন্তু তাদের মতো একস্ট্রাদের বেছে নেওয়ার মতো সময় তাদের নেই। সেই কাজটা করে কানা শমসের বা তারই মতো অন্য কেউ।
হেনার পরনে একটা ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের সালোয়ার-কামিজ। চুড়িদারের সঙ্গে আঁটো-সাঁটো শর্ট কামিজ যেন তার শরীর কামড়ে ধরে রেখেছে। ঠোঁটে সস্তা লাল টুকটুকে লিপস্টিক, পাউডার লেপ্টে আছে মুখে-গলায়, ঘাড় অবধি। এটাই দস্তুর। এফডিসির একস্ট্রা শিল্পীদের এভাবেই যেতে হয়। ইদানীং অবশ্য পত্রিকাঅলারা তাদের একটা গালভরা নাম দিয়েছে, জুনিয়র শিল্পী।

হেনা তাকে তাগিদ দেয় তাড়াতাড়ি রেডি হওয়ার জন্য। একটা ঘরেই তাদের মা-মেয়ের সংসার। সে ঘরের এক কোনায় গিয়ে পরণের শাড়ি, ব্লাউজ আর পেটিকোট পাল্টায়। সবেধন নীলমণি বহুব্যবহারে নরম হয়ে আসা লাল রঙের পাতলা শিফনের সঙ্গে কালো ব্লাউজ। ম্যাচ না করলেও কিছুই করার নেই। বাইরে পরে যাওয়ার মতো তার ব্লাউজ আছে মাত্র দুটো। আরেকটা সাদা, কিন্তু বেশি পুরোনো হয়ে গেছে। ঘরের টিনের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা আয়নার দিকে তাকিয়ে সে চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, গালে রুজ আর পাউডার লাগায়। মনে হচ্ছে তাকে মন্দ লাগছে যদিও তার গায়ের রঙ কিছুটা চাপা। রঙের মালিন্য সে ঢেকে দিয়েছে বেশি করে রুজ আর পাউডার দিয়ে।
সে যখন চুল আঁচড়াচ্ছে তখনি তার মেয়ে জেগে ওঠে। কান্না কান্না গলায় মা’কে জিজ্ঞাসা করে মা, তুই কৈ যাস?
এফডিসি।
না, তুই যাবি না। আমি আইজ একলা থাকতে পারুম না।
পাগলি মাইয়া! আমি তো রাইত অওনের আগেই আয়া পড়ুম। তুমার খিদা লাগলে পাতিলে জাউ আছে, খায়া লইয়ো।
মা, আইজকা কি তোর শুটিং আছে?
না রে মা, মহরত আছে, নতুন বইয়ের। কইসে দুই শ ট্যাহা দিবো গেলে। তুমার লাইগা বালা কিস্যু কিইনা আনমু নে।
মহরতের কথায় ময়নার জ্বরে মিইয়ে যাওয়া চোখ হঠাৎ চকচক করে ওঠে। সে জানে, মহরতে বড় কেক কাট হয়। বছর দুয়েক আগে তার মা একবার তার জন্য এনেছিল। মহরতে কেক কাটা হলেও পারুলের মতো একস্ট্রারা তার ভাগ পায় না। তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি করে মিষ্টির প্যাকেট যেখানে থাকে একটি ছোট সাইজের মিষ্টি, এক টুকরো জিলিপি, সঙ্গে একটি করে সিঙ্গারা বা নিমকি। এক পরিচালক তার সিনেমার মহরতে কেক কাটার পর সবাইকে কেকের টুকরো দিয়েছিল। পারুল তার ভাগেরটা না খেয়ে মেয়ের জন্য নিয়ে এসেছিল। মেয়ে এখনো সেই কেকের কথা ভোলে নি।
মা, আইজকা কি তোরে কেক দিবো?
জানি না মা। দিলে তোমার লাইগা লয়া আমুনে।
পারুলের মনটা হঠাৎ করেই বিষণ্ন হয়ে যায়। তার বিয়ে হয়েছিল রাজমিস্ত্রি হানিফ শেখের সাথে। জোয়ান-তাগড়া ব্যাটাছেলে। আয়-রোজগারও কম ছিল না। ময়না হওয়ার পর গ্রাম থেকে তাকে নিয়ে ঢাকায় এসে সংসার পেতেছিল। বড় সুখের ছিল সে দিনগুলি। পারুলের শখ ছিল সিনেমা দেখার। মানুষটা তাকে প্রায়ই সিনেমা দেখাত– বলাকা, বিনাকা, আনন্দ, গ্যারিসনে। স্বামীর সঙ্গেই প্রথম শখ করে এফডিসি দেখতে গিয়েছিল সে। গেটের পাশে দুজনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল নায়ক-নায়িকা দেখার আশায়, তার কোলে ছোট্ট ময়না। কাবিলাকে দেখেছিল সে, মনে আছে। হানিফ শেখ তাকে ফানটার বোতল আর চিপস কিনে দিয়েছিল। হঠাৎ মানুষটার কী যে হলো! আরেকটা বিয়ে করল। ফেলে রেখে গেল পারুল আর কোলের বাচ্চাকে।
তাড়াতাড়ি কর না রে। আবার কী অইলো? মুরগির মতো ঝিমাস ক্যান? দেরি অইয়া যাইতাছে তো।
হেনার কথায় সংবিত ফিরল। ময়নার গা ছুঁয়ে দেখল আবার জ্বর আসছে কি না। মেয়ের গা অল্প একটু গরম। ওষুধ কাজ করছে। নিজেকে সান্তনা দিয়ে সে ঘরের বাইরে পা ফেলল।
মা চলে যাওয়ার পর ময়নার কেমন যেন ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। সে গায়ে জড়ানো কাঁথাটার ভেতরে আরও বেশি গুটি-শুটি হয়ে শুয়ে পড়ল। তার জ্বর বাড়ছে, গা কাঁপছে; কিন্তু দু’বছর আগে খাওয়া কেকের স্বাদ আর গন্ধ কেমন ছিল তা সে মনে করার চেষ্টা করছে।

এখন প্রায় বিকেল। এফডিসিতে আজকাল আগের মতো অত বেশি শুটিং হয় না তবুও দুই নম্বর ফ্লোরে বেশ ভিড়। পারুলরা যখন সেখানে পৌঁছল তখনো নায়ক এসে পৌঁছায় নি, নায়িকা এসেছে। প্রধান অতিথি একজন মন্ত্রী। তিনিও আসেন নি। তার জন্য ফুলের তোড়া হাতে অপেক্ষা করছে দুই শিশুশিল্পী। বেচারাদের কড়া মেকআপ গরমে টিকতে না পেরে মাখনের মতো গলে গলে যাচ্ছে। থলথলে শরীরের বয়স্ক প্রযোজক নায়িকার পাশের চেয়ারে বসে গল্প করার ছলে মাঝেমধ্যেই তার লোমশ হাতে বিশাল থাবা বসাচ্ছেন নায়িকার পিঠের খোলা জায়গায়। নায়িকা হাসিমুখে গল্প শুনছে, মনে হচ্ছে এত মজাদার গল্প সে জীবনে শোনে নি। পরিচালক বিরক্ত মুখে হাতের ঘড়ি দেখছেন। এরইমধ্যে নায়ক চলে এল। সে মিনিটে কয়েকবার চুলে হাত বুলাচ্ছে, যেন এটাই পৃথিবীতে তার প্রধানতম কাজ। পারুলের একবার মনে হলো, একটা চিরুনি কিনে নায়ককে উপহার দিলে মন্দ হতো না।
কানা শমশের মহাব্যস্ত। একবার ডেকোরেটরের লোককে ধমকাচ্ছে, আরেকবার পরিচালকের কাছে গিয়ে কী যেন বলে আসছে, আরেকবার মাইকের লোকের কাছে আসছে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তার চোখ সার্চলাইটের মতো মেয়েদের শরীরে ঘুরছে, লঞ্চের সার্চলাইট যেমন ঘুরে ঘুরে ডুবোচর খোঁজে।
একফাঁকে পারুল হেনাদের কাছ থেকে উঠে শমশেরের কাছে গেল।
কি রে সুন্দরী? কথা কইলেই তে চটাস চটাস জবাব দেস, আইজ কী মনে কইরা?
পারুল তার টিটকারি গায়ে মাখল না। গলার স্বর যতটা মোলায়েম করা যায় তা করে বলল, শমশের ভাই, আমার একটা আবদার আছে, রাখবা?
একটা ক্যান? তোর সব আবদার রাখব। কথা বলার ফাঁকে শমশের যেন তার শরীরটাকে কুকুরের মতো চাটতে থাকে।
শমশের ভাই, আইজকা আমারে এক টুকরা কেক দিবা? মাইয়াডার জ্বর, ওর লাইগা নিয়া যামু। পারুলের কণ্ঠে আকুতি ভর করে।
কস্ কী মাগি! সোনারগাঁও হোটেলের কেক, খালি ভিআইপি গো লাইগা। যা, তোরে দুইডা মিষ্টির প্যাকেট দিমুনে, খুশি?
শমশের তার আঁচল সরে যাওয়া পুরুুষ্টু বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে এক চোখে, আরেক চোখ নির্বিকার।
শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে পারুল। চোখ টিপে বলে, শমশের ভাই, তুমি তো আমার আপন মানুষ, তুমি কিছু চাইলে কি আমি না করমু? তাইলে তুমি না করতাছো ক্যান?
শমশেরের জীবন্ত চোখটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য পাশের মরা চোখের মতো স্থির হয় যায়। তারপর হিস্হিস্ করে বলে ওঠে, মহরত শেষ অইলে গুদামের পিছনে থাকিস।
পারুল ফিরে আসে তার সখীদের কাছে। হেনা জিজ্ঞেস করে, কানা শমশেরের সাথে কী এত কথা কইলি রে পারুল?
সে কোনো জবাব দেয় না। একটি গোপন দীর্ঘশ্বাস এফডিসির বাতাসে নায়ক-নায়িকাদের গায়ের সুগন্ধীর সঙ্গে মিলিয়ে যায়।
প্রধান অতিথির গাড়ি দুই নম্বর ফ্লোরের সামনে আসতেই সবাই ব্যস্ত হয়ে যায়। ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরার আলোর ঝলকানি আর শাটারের শব্দে মুখরিত মঞ্চে ওঠেন মন্ত্রীসাহেব। তার দু’পাশে নায়ক-নয়িকা, পরিচালক আর প্রযোজক। সামনের টেবিলে নানাবর্ণের ফুলের মাঝে বিশাল এক কেক। তিনি বক্তৃতা দেন বাংলা সিনেমার সোনালি অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে। সিনেমার জন্য তার পরিকল্পনার কথা বলেন। শমশের মঞ্চের এক কোনায় দাঁড়িয়ে মন্ত্রীর একটি করে বাক্য শেষ হওয়ার পর হাততালি দেয়। তার ইশারায় সে হাততালি ছড়িয়ে পড়ে সবার মধ্যে। এজন্যই তাদের আনা হয়েছে, পারিশ্রমিক দুই শ’ টাকা মাত্র।
মন্ত্রী কী বলছেন তার একটি অক্ষরও পারুলের কানে প্রবেশ করে না। তার শকুনির মতো চোখ স্থির হয়ে আছে সামনের টেবিলে ফুলশোভিত কেকের গায়ে।


অনেকক্ষণ আগেই সন্ধ্যা বিদায় নিয়েছে এ শহর থেকে। রাত তার রাজত্ব শুরু করেছে। মহরত শেষ। মন্ত্রীসাহেব চলে গেছেন। যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে ছবি তুলেছেন, অবশ্য নায়িকার সঙ্গে একটু বেশি সংখ্যায়। পারুল হেনাকে বিদায় দেয়। বলে, তার আরেকটু কাজ আছে, পরে যাবে। পারলে সে যেন একটু ময়নার কাছে থাকে। হেনা কী যেন বুঝে ফেলে, কোনো প্রশ্ন না করেই বিদায় নেয়। মাইকওয়ালা আর ডেকোরেটরের লোকজন তাদের জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। বেশকিছু লাইট এরইমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শমশের এখনো তার মাতব্বরি নিয়ে ব্যস্ত।
এদিক-সেদিক তাকিয়ে পারুল পা বাড়ায় অন্যদিকে। সতর্ক চোখে দেখে কেউ আবার দেখে ফেলল কি না। এফডিসির গুদামটা খানিকটা দূরে। একসময়ে সে গুদামের পেছনে পৌঁছে যায়। এ জায়গায় আলো নেই, নিকষ অন্ধকার। সে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। দেয়ালে হেলানরত তাকে কেমন যেন অপার্থিব মূর্তির মতো লাগে।
কোথাও একট নেড়ি কুত্তা অবিরাম কেঁদে যাচ্ছে। পারুল অপেক্ষায় আছে, শমশেরের, কানা শমশের।
দূর থেকে একটি ছায়ামূর্তি হেঁটে আসে। তার হাতে প্যাকেটের মতো কিছু একটা। পারুলের কাছে এসে থামে।
নে, তোর মেয়ের কেক। অনেক কষ্ট কইরা আনতে অইছে। আয় এবার।
সমস্ত অন্ধকার মৌ মৌ করতে থাকে দামি হোটেলের চকোলেট কেকের গন্ধে। পারুল প্যাকেটটা তার পাশে কংক্রিটের মেঝেতে রাখে। তারপর বসে পড়ে সেখানেই। শমশেরের দু’হাত তাকে গ্রাস করতে থাকে, এক ভয়ংকর অজগর তার সমস্ত শরীর পেঁচিয়ে ধরে। সে ভেঙে যেতে থাকে আস্তরবিহীন পুরোনো দালানের মতো।
ততক্ষণে আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে, নির্লজ্জের মতো সে তাকিয়ে আছে মাটির পৃথিবীর দিকে। সেখানে এক টুকরো কেক তার সুবাস ছড়াচ্ছে। একটি বালিকা একা ঘরে জ্বরে কাতরাচ্ছে, তার নাকেও যাচ্ছে সেই কেকের সুবাসিত গন্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আবারো এস আলমে আগুন 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় এস আলম গ্রুপের চিনির গুদামের পর এবার তেলের মিলে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের...

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...