স্বপ্নভঙ্গের দেশের ভোট রঙ্গ

Date:

Share post:

ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে বছর তিনেক আগে প্রথম ‘উবার’ নামটি শুনি। তখন ‘উবার’ ধারণাটি মাত্র প্রকাশ হচ্ছিল। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে উদ্ভুত এই ধারণাটি কোম্পানিতে রূপ নিয়েছে, তাও বেশিদিন হয়নি।
কোম্পানিটি তার প্রচার-প্রসারের কাজ শুরু করেছে কেবল। দেশের এক তরুণ প্রকৌশলী তখন কাজ করেন ‘লিঙ্কন্ড ইন’এ। তিনি আমাকে গুগল, ফেসবুক ঘুরে দেখিয়ে যখন ‘লিঙ্কন্ড ইন’ ক্যাফেটেরিয়ায় কফি খাওয়াতে বসলেন, তখনই জানালেন- তিনি উবারে যোগ দিচ্ছেন। সঙ্গে বুঝিয়ে দেন এই উবার কিভাবে কাজ করবে। অলস বসে থাকা গাড়ি বা গাড়ির মালিক কিভাবে শহরের গণপরিবহন চাহিদা মেটাতে পারেন, সেই আয় করতে পারবেন বাড়তি কিছু, সেই ধারণাটি শুনে মুগ্ধই হয়েছিলাম।
মুগ্ধতার সঙ্গে মন খারাপ হয়েছিল এই ভেবে যে, আমাদের ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে যেমন যানজট তাতে অলস বসে থাকা গাড়িকে কে রাস্তায় নামাবে? ভাবনায় এটাও ছিল আমেরিকায় অলস বসে থাকা গাড়ির মালিক করতে তার মান-সম্মান নিয়ে ভাববেন না। সেখানকার সমাজেরও এ বিষয় নিয়ে ভাববার বিন্দুমাত্র ফুরসত নেই।
কিন্তু বাংলাদেশে কোনও , শিক্ষক, প্রকৌশলী, কোনও প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ কি অবসর সময়ে উবার চালক হবেন? তিনি তো তার সামাজিক স্ট্যাটাসের কথাই ভাববেন। জাত গেল জাত গেল বলে… বাঙালিরতো অনেক কিছুই হলো না। এই ভাবনা নিয়েই সেইবার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফিরেছিলাম।
বছর না ঘুরতেই দেখি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক শহরে স্মার্টফোন ভিত্তিক ট্যাক্সিসেবা উবার চালু হচ্ছে। সবার মুখে উবারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। উবার সেবায় গ্রাহকরা সন্তুষ্ট। যে সব শহরে দীর্ঘদিন থেকে ট্যাক্সি সেবা চালু ছিল, কিন্তু ট্যাক্সিচালক বা সেবার নানা রকম বিড়ম্বনায় পড়তেন যাত্রীরা তারা উবার পেয়ে খুশি। পাশের শহর তেও উবার বাজিমাত করেছে। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন দেখতে গিয়ে দেখলাম হলুদ-সবুজ সকল রঙের ট্যাক্সি চালকরা চিন্তিত। তাদের আয় রোজগারে ভাটা পড়েছে। যাত্রীরা ট্যাক্সি না ডেকে উবার ডাকছেন। নিজেও উবার ডেকে দেখলাম অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী এবং সেবার মানও ভালো। আমেরিকা থেকে ফিরে এখনও উড়োজাহাজ যাত্রার ক্লান্তি এবং দিবা-রাত্রীর গড়মিলের ঘোর কাটেনি। চারদিন আগে ‌এক াদিক বন্ধু, এখন বিজ্ঞাপন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ফোন দিয়ে বললেন- একটি ব্রেকিং নিউজ দেই। ঢাকার রাস্তায় উবার নামছে আজ থেকেই। কথা সত্যি ঢাকার রাস্তায় উবার। প্রথম যাত্রী হয়েছেন ার সাকিব আল হাসান। মাধ্যমেও দেখলাম সবাই উবারকে স্বাগত জানাচ্ছেন। এবং বন্ধুদের অনেকে, যাদের গাড়ি আছে তারা উবার সেবা দেওয়ার জন্য অ্যাপসে যেয়ে নিজের নাম যুক্ত করছেন। একদিন বাদেই দেখি তাদের কেউ কেউ উবার সেবা দিয়ে আয়ের খবরও জানাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

ঢাকায় টেক্সি সেবা চালু হয়েছিল। নাগরিকদের ভোগান্তি-বিড়ম্বনা ও নিরাপত্তাহীনতার সর্বোচ্চ উপহার দিয়ে রাস্তা থেকে উঠে গেছে একের পর এক কোম্পানি। বেশ কিছু সময় পর স্বল্প সংখ্যায় কিছু টেক্সি-ক্যাব রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু তা সাধারণের সাধ্যের বাইরে। গণমানুষের জন্য ট্যাক্সি নামানোর নানা উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর, উবার চালু হয়েছে। মনে হলো উবার সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানাতে একটি প্রতিবেদন করা দরকার। বিশেষ করে উবার সেবার সঙ্গে যাত্রী নিরাপত্তার বিষয়টিও যুক্ত। রিপোর্টার মাঠে গেল। তার সঙ্গে বিআরটিএ এবং পুলিশের কেউ কথা বলে না। কারণ তারা উবার কী সেটাই জানেন না। কখনও শুনেননি উবারের কথা এমন কর্মকর্তাও আছেন। রিপোর্টার নিরাশ হয়ে ফিরে আসার পর আমি পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করে অনুরোধ করি- উবার বিষয়ে মন্তব্য দেওয়ার জন্য। তিনি আমার কাছেই জানতে চান উবার কবে চালু হলো? তারপর আমাকে টেলিফোনে রেখেই কয়েকজন কর্মকর্তাকে ইন্টারকমে উবারের কথা বললেন। বুঝতে পারলাম ওই কর্মকর্তাদের কারও উবার সম্পর্কে জ্ঞান নেই। তিনি ওই কর্মকর্তাদের উবার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে বললেন। ওয়েব সাইট ঘাটতে বললেন। তারপর আমাকে জানালেন আমরা নিজেরা একটু বুঝে নেই তারপর কথা বলি। আমি শুধু তাকে বললাম আর্ন্তজাতিক একটি ন ভিত্তিক একটি ট্যাক্সিসেবা রাজধানী চালু হয়ে গেল, আর আপনারা টেরই পেলেন না? আপনারা আছেন নাকি নাই? ওই কর্মকর্তা ফোন রেখে দেন আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে।

দ্বিতীয় দিনেও পুলিশ এবং বিআরটিএ কোনও মন্তব্য করেনি। তবে বৃহস্পতিবার ২৪ নভেম্বর বিআরটিএর একজন পরিচালক স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি শুক্রবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ওই বিবৃতিতে স্মার্টফোন ট্যাক্সিসেবাকে অবৈধ, বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। এই বিজ্ঞপ্তি দেখে সাধারণ নাগরিকেরা আর হাসি চেপে রাখতে পারছেন না। বিআরটিএ’র জ্ঞান এখনও ট্যাক্সি সেবা বলতে কালোবডি হলুদ টপেই সীমিত। ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে বলতে গলা ভেঙে আসা আমলাতন্ত্র নিজেদের দুর্নীতির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে, এমন ডিজিটাল সেবাকে আতুঁড় ঘরেই মেরে ফেললেন। বিআরটিএ এবার যেভাবে লাফিয়ে উঠে উবারকে ঝেঁটে দিলো, তা দেখেও রবাসী বিস্মিত। যার আঙ্গিনায় প্রতিদিন সকাল-বিকাল অবৈধ রুটপারমিট দেওয়া হচ্ছে, ভুয়া লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, যে শহরে সকলের নাকের ডগা দিয়ে রুটপারমিটহীন যানবাহন চলছে, লাইসেন্স না নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, অবৈধ জরাজনীর্ণ গাড়ি চলছে সেই শহরের বিআরটিএ এবং ট্রাফিক পুলিশ উবারকে ক্রসফায়ারে ফেলতেই পারে। তারা উবারকে অবৈধ না বলে, নিজেরা উবারের এই অনলাইন সিস্টেমের সঙ্গে নিজেদের আত্মীয়তা তৈরি করতে পারতো। যদি প্রকৃতঅর্থেই তারা যাত্রীবান্ধব প্রতিষ্ঠান বা বাহিনী হয়ে থাকেন।

হলো উবার কোনও সবুজ সংকেত ছাড়া পথে নিশ্চয়ই নামেনি। রাষ্ট্রের কোনও না কোনও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকতে পারে। সেই কর্তৃপক্ষ নিশ্চিয়ই এখন সজাগ হবেন। আর যদি তা না হয়ে উবার দুঃসাহসিক ভাবেই পথে নেমে পড়ে থাকে, তাহলে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বা ট্রাফিকের নজরদারীর গলদটাই প্রকাশ্যে এসে যায়। যাইহোক সব অংকের হিসেব চুকিয়ে ভাগশেষে বলতে চাই-সাধারণ যাত্রীদের নিরাপদ সেবা দিতে বিআরটিএ এবং পুলিশ উবারকে প্রশ্রয় দিতেই পারেন। আজকে না হয় দুর্নীতির স্বার্থে উবার ফিরিয়ে দিলেন। কাল আরেকটি ডিজিটাল অ্যাপসে আপনার দুর্নীতি ধরা পড়বেই। অতএব আজই হোক না আত্মসমপর্ণ। আমরা কিছু মনে করবো না।

তুষার আবদুল্লাহ : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আমরা উদ্বিগ্ন, দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে : আসিফ মাহমুদ

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিয়ে...

হঠাৎ মিসাইল ছুড়ল উত্তর কোরিয়া

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার মধ্যেই রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ের সুনান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ১০টি মাল্টিলঞ্চার মিসাইল উৎক্ষেপণ করেছে উত্তর কোরিয়া। বৃহস্পতিবার (১৯ জুন)...

এবার ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপেছে উত্তর কোরিয়া

ইরানের ওপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে,...

আসছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘এরিক’

মেক্সিকোর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের দিকে দ্রুত ধেয়ে আসছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘এরিক’। দেশটির জাতীয় আবহাওয়া সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, এটি...