বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতাকে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার কথা ভাবছে ভারত

Date:

Share post:

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশের সীমান্তজুড়ে নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের উদ্বেগ দূর করার পর থেকেই ঢাকার এই ভূমিকার প্রশংসা করে চলেছে দিল্লি। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতাকে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার কথা ভাবছে ভারত। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ঘোষণা আসতে পারে।

গতকাল সোমবার ও গত রোববার কূটনৈতিক সূত্রগুলোতে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সম্প্রতি ভারতের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা সহযোগিতার জন্য এক রূপরেখা চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবে প্রযুক্তির বিনিময়, প্রশিক্ষণ ও যৌথ মহড়ার মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ দমনে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়গুলো থাকছে। শেখ হাসিনার সফরের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার জন্য ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকরের দুই দিনের সফরে ৩০ নভেম্বর ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। এ সময় দুই দেশের সহযোগিতার অন্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি রূপরেখা চুক্তির বিষয় নিয়েও তিনি আলোচনা করবেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয় হিসেবে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সফরে তিস্তার পানি নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি অববাহিকাভিত্তিক পানি-ব্যবস্থাপনাসহ পানিসম্পদ খাতে সহযোগিতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, বাণিজ্য, বহুমাত্রিক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, ভিসা ব্যবস্থা সহজীকরণের প্রসঙ্গও উঠবে। গত এক বছরের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি ভারত তুলতে পারে। এ ছাড়া সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র হিসেবে পারমাণবিক শক্তি, মহাকাশ, স্যাটেলাইট নিয়ে দুই দেশ কাজ করছে। বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বড় প্রকল্পে নতুন প্রক্রিয়ায় ভারতের অর্থায়নের ব্যাপারে দুই দেশ আলোচনা শুরু করেছে। ভারতের দেওয়া প্রথম ঋণ সহায়তা বাস্তবায়নের প্রায় শেষ পর্যায়ে এবং দ্বিতীয় ঋণ সহায়তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো খাতে সৃজনশীল পন্থায় অর্থায়নের ঘোষণা আসতে পারে। এ ব্যাপারে সম্ভাব্য প্রকল্পগুলো চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। এই সফরে অন্তত ২০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই দেশ।

সফরের দিনক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা  বলেন, প্রধানমন্ত্রী ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে যাবেন। তবে সফরের সময়সূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। খসড়া সফরসূচি অনুযায়ী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের পাশাপাশি সে দেশের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন শেখ হাসিনা। এ ছাড়া কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। দিল্লি সফরের সময় শেখ হাসিনা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরিবারের সদস্যদের শ্রদ্ধা জানাবেন। রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতেও শ্রদ্ধা জানাবেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর আজমির শরিফ যাওয়ার কথা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সফরটি ডিসেম্বরের ১৭ থেকে ২০ তারিখ হতে পারে। ঢাকার কর্মকর্তারা মনে করেন, হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠকটি ১৮ ডিসেম্বর বিকেলে হলে সফরটি ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর হতে পারে। আর বৈঠকটি ১৮ তারিখ দিনের শুরুতে হলে প্রধানমন্ত্রী ১৭ ডিসেম্বর দিল্লি যেতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রীর সফর প্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ৮ থেকে ১০ নভেম্বর দিল্লি যান। এ সময় শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের তারিখ ৩ ও ৪ থেকে পিছিয়ে ১৭ থেকে ২০ ডিসেম্বর করা হয়। শহীদুল হক দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্করের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সফরের আলোচ্যসূচি, কর্মসূচিসহ খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। এ ছাড়া প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পানিসম্পদসচিব শশী শেখরের সঙ্গে আলোচনা করেন শহীদুল হক।
শহীদুল হক বলেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকে গত বছরের আলোচনার সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করা হবে। এ ছাড়া দুই দেশ নতুন করে কোন কোন ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সে ব্যাপারেও তাঁরা কথা বলবেন।

তিস্তা ও গঙ্গা ব্যারাজের ভবিষ্যৎ: গত বছর সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়নের পর তিস্তা চুক্তি সইয়ের জন্য অধীর অপেক্ষায় আছে। তা ছাড়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশেষ পর্যায়ে নেওয়ার দাবির যৌক্তিকতা জোরালো করতে অভিন্ন নদীটির পানিবণ্টনের চুক্তি সই বাংলাদেশের জন্য খুব জরুরি। গত বছরের জুনে ঢাকায় এসে মোদি শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, সীমান্ত চুক্তির বিলের মতো তিস্তা চুক্তিও তিনি সর্বসম্মতভাবেই করতে চান। এ জন্য কিছুটা সময় চেয়েছিলেন। বাংলাদেশ এখনো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কথায় ভরসা রেখেছে। গত বছরের বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থে পানিসম্পদের সব বিষয় নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) ৩৮তম বৈঠকে প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন দুই প্রধানমন্ত্রী। মাস দুয়েক আগেও তিস্তা নিয়ে সরকারের মধ্যে একধরনের উচ্চাশা থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর সফরের দিনক্ষণ কাছে আসার সঙ্গে আশাটা খুব জোরালো দেখাচ্ছে না। বরং গত মাসে ভারতের একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিনে প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের স্থানটি ঘুরে যাওয়ার পর বাংলাদেশ বড় প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছে। কারণ, গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প নিয়ে ভারতের অনেক প্রশ্ন ছিল। এবার প্রতিনিধিদলটির বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে খুব শিগগির একটি যৌথ সমীক্ষা শেষে প্রকল্প নিয়ে ভারতের সহযোগিতার ঘোষণা আসবে। শেষ পর্যন্ত ভারত এ নিয়ে কোনো ঘোষণা দিলে তা প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে বড় অর্জন হিসেবে বিবেচিত হবে।

চীন নিয়ে প্রশ্ন ও নতুন রূপরেখা: তিন দশক পরে চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর নিয়ে এমনিতেই ছিল নানা কৌতূহল। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সহযোগিতা, এক পথ ও এক অঞ্চল এবং কৌশলগত সহযোগিতায় যুক্ততার ঘোষণায় এ অঞ্চলের বাইরে বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে। চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের এত কিছু একসঙ্গে হওয়াটা প্রতিবেশী ভারতকে কিছুটা চিন্তিত করে তুলেছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর ঢাকায় আসছেন। এ সফরের সময় তিনি দুই দেশের নিরাপত্তা সহযোগিতার এক নতুন রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করবেন। মোদির ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত পারিকর এই সফরে ঢাকায় এসে দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলবেন। সেই সঙ্গে তিনি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গতিপথটা জানার চেষ্টা করবেন।

জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও কলম্বোভিত্তিক গবেষণা সংস্থা রিজিওনাল সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ  বলেন, ‘চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের পর শেখ হাসিনার দিল্লি সফরটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে, বাংলাদেশের জন্য চীনের বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা ও কৌশলগত সহযোগিতায় যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত ভারতকে কিছুটা হলেও অবাক করেছে। উন্নয়ন ও নিরাপত্তা দুটি আলাদা বিষয় এবং এ দুটো বিষয়কে এক করে ভাবার সুযোগ নেই, শেখ হাসিনা এটি নরেন্দ্র মোদির কাছে কীভাবে স্পষ্ট করবেন, সেটি দেখার আছে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আবারো এস আলমে আগুন 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় এস আলম গ্রুপের চিনির গুদামের পর এবার তেলের মিলে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের...

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...