পৃথিবীর কার্বন ডাই অক্সাইডের ওপর নজর রাখার জন্যে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিলো একটি স্যাটেলাইট। নাম ও সি ও টু। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এটি উৎক্ষেপণ করেছিলো ২০১৪ সালের মাঝামাঝি। এই প্রথম সেখান থেকে পৃথিবীতে তথ্য পাঠানো হয়েছে। এবং সেখান থেকে পাওয়া গেছে কার্বন ডাই অক্সাইড সম্পর্কে নতুন কিছু ধারণা।
আমরা সবাই জানি- বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। কারণ – আমরা জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়চ্ছি, বন জঙ্গলের গাছপালা কেটে ফেলছি। ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বৃদ্ধিটা কিন্তু উঠা-নামা করে। এই কার্বন ডাই অক্সাইডকেই দায়ী করা হয় জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্যে।
কার্বন অবজারভেটরি স্যাটেলাইটটি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটি দেখছে পৃথিবী কিভাবে শ্বাস নেয়, কোথায় কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি এবং পরিবেশের কারণে এটি কিভাবে প্রভাবিত হয়।
ও সি ও টু প্রত্যেক মাসে দু’বার পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আসে। সারা বিশ্বে স্থাপিত দেড়শোটির মতো কেন্দ্রে এই স্যাটেলাইট থেকে তথ্য পাঠানো হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে -অদৃশ্য এই কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসকে স্যাটেলাইটটি কিভাবে দেখতে পায়।এই প্রকল্পের উপ পরিচালক ও বিজ্ঞানী আনম্যারি এল্ডারিং বলেছেন, “পৃথিবীর পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে সূর্যের আলো যখন বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে আমাদের স্যাটেলাইটে গিয়ে পৌঁছায় সেটা মেপে দেখার জন্যে আমরা একটা পদ্ধতি ব্যবহার করি।”
“কিছু কিছু অণু আছে যা খুব নির্দিষ্ট আকারে ওই আলোকে ধারণ করতে পারে। কার্বন ডাই অক্সাইড হচ্ছে এমন একটি গ্যাস যা আলোর বর্ণচ্ছটাকে পরিবর্তন করতে পারে। আমরা তখন আলো ও কার্বন ডাই অক্সাইডের ওয়েভলেন্থ পরিমাপ করি। সেই পরিমাপ থেকে আমরা বুঝতে পারি আলোর ভেতর দিয়ে কতোটুকু কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথিবীর পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে স্যাটেলাইটে গিয়ে পৌঁছেছে।”
এই স্যাটেলাইটের উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীর চারপাশে কোথায় কতোটুকু কার্বন ডাই অক্সাইড আছে তার একটি মানচিত্র তৈরি করা।
তিনি বলেন, “কার্বন ডাই অক্সাইডের উৎস কি, বায়ুমণ্ডলে এর প্রভাব কি ধরনের, সমুদ্রের সাথে এটি কি ধরনের আচরণ করে- এসব জানার জন্যেই এই স্যাটেলাইলটটি পাঠানো হয়েছে। এসব বোঝার জন্যে প্রত্যেক কিলোমিটারে কি হচ্ছে সেটা জানার দরকার নেই। কারণ পরিবেশের ওপর কার্বন ডাই অক্সাইডের যে প্রভাব পড়ে, সেটা একটা বৃহৎ ও বিস্তৃত পরিসরেই ঘটে থাকে।”
“কোথায় কোন অরণ্যে বা কোন জায়গায় কি হয়েছে, এসব তথ্য থেকে আমরা একটা ধারণা পাই। শুধু একদিনেই আমরা পাই এক লাখেরও বেশি তথ্য। সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আমরা পৃথিবীতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণের ব্যাপারে একটা ধারণা পেতে পারি,” বলেন তিনি।
“এখন আপনি যদি জানতে চান গত মে মাসে কি হয়েছিলো, এই স্যাটেলাইট থেকে আমাদের কাছে ওই এক মাসে যে তিরিশ লাখেরও বেশি তথ্য এসেছে, সেসব থেকে আমরা বুঝতে পারবো যে ওই মাসে আসলেই কি হয়েছিলো।”
এখনও পর্যন্ত যেসব তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেছে সেসব থেকে সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রত্যেক বছরেই বাড়ছে।
কিন্তু এই বৃদ্ধিটা যে সবসময় একই হারে বাড়ছে তা নয়। দেখা গেলো কোনো মাসে হয়তো বেশি আবার কোন মাসে কম। এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে?
বিজ্ঞানী আনম্যারি এল্ডারিং বলছেন, এই কার্বন-চক্রের দুটো প্রধান দিক আছে।
“একেক ঋতুতে এর পরিমাণ একেক রকমের হয়। বিশেষ করে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে। এই অংশেই কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের বসবাস। এখানেই অনবরত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হচ্ছে আর সেটা হচ্ছে মানুষের কারণে।”কিন্তু দেখা গেছে, যেসব জায়গায় বসন্তকাল আসে সেখানকার বায়ুমণ্ডলে এই কার্বন ডাই অক্সাইডের চিত্রটা একটু বদলে যায়। এর কারণ হলো সেসময় গাছপালায় পাতা গজায় এবং গাছগুলো খুব দ্রুত বড় হতে থাকে। এসব গাছপালা কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেয়। ফলে সেসব জায়গায় গ্রীষ্ম ও বসন্ত কালে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব কমে যায়। কিন্তু দেখা গেছে শীত কালে গাছপালাগুলো প্রায় মরে যায়, কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন ঘটতেই থাকে। ফলে বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাসের ঘনত্ব বাড়তেই থাকে। ফলে এটা কখনো বাড়ে আবার কখনও কমে। অর্থাৎ নির্গমন অব্যাহত থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন সময়ে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ উঠা নামা করে।”
মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে যতো কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয় তার অর্ধেকই কিন্তু শুষে নেয় সমুদ্র আর মহাসমুদ্র। কিন্তু প্রত্যেক বছরেই সমান পরিমাণে শুষে নেয় না। কোন বছর হয়তো ২৫ শতাংশ আবার কোন বছরে ৮০ শতাংশ।
২০১৫ এবং ২০১৬ সাল খুবই তাৎপর্যময় দুটো বছর যখন বড় রকমের এল নিনিওর ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে কোথাও বেশি তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়েছে। আবার কোথাও খরা দেখা দিয়েছে। এর কারণ হলো, নাসার এই স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্তে দেখা গেছে, গত দু’বছরে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব ছিলো গত ১০ হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
উড়ন্ত ল্যাবরেটরি
আইসল্যান্ডের সক্রিয় আগ্নেয়গিরির উপর নজর রাখছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা। আর এজন্যে তারা একটি পুরো বিমানকে ল্যাবরেটরিতে পরিণত করেছেন।
তারপর সেই বিমানে করে ন্যাশনাল সেন্টার ফর এটমোসফেরিক সায়েন্সের বিজ্ঞানীদের দলটি উড়ে বেড়াচ্ছে আগ্নেয়গিরিগুলোর চারপাশ দিয়ে। তারা বলছেন, ভবিষ্যতে এসব আগ্নেয়গিরিতে কখন কখন অগ্নুৎপাত হতে পারে সেটা বোঝার জন্যেই এই গবেষণা।
বিমানটির ভেতরে গবেষণার জন্যে যাত্রীদের আসনের বদলে সেখানে নানা রকমের যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে। আকাশে উড়ার সময় বিমানটি বাইরে থেকে যেসব কণা শুষে নেয় এসব যন্ত্রে সেসব পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা হয়।উড়ন্ত এই ল্যাবের জানালা দিয়ে দেখা যায় সক্রিয় আগ্নেয়গিরির মুখ। উপর থেকে এগুলোকে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। কারণ এর আগে ২০১০ সালে আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরিতে অগ্নুৎপাতের ফলে বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে বড় রকমের বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিলো। আবারও যাতে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে না পারে সেজন্যেই এই গবেষণা। আইসল্যান্ডিক আবহাওয়া বিভাগের একজন বিজ্ঞানী ড, গুরুন নিনা পিটারসন বলেন, “আমরা বিভিন্ন উচ্চতায় উঠতে পারছি। ফলে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরের কোথায় কি ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে সেটা মেপে দেখতে পারি।”
“এই গবেষণায় এসব আগ্নেয়গিরি কিভাবে আচরণ করে সে সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারবো। অথবা বলতে পারেন আমরা বুঝতে পারবো যে এসব আগ্নেয়গিরি কিভাবে শ্বাস নিচ্ছে।”কাটলা আগ্নেয়গিরির মাত্র পাঁচশো মিটার উপর দিয়ে উড়ে যায় গবেষণাগারটি। ১৯১৮ সালে এখানে সর্বশেষ অগ্নুৎপাতের ঘটনা ঘটেছিলো।
এটি খুবই সক্রিয় আর সেকারণে বিজ্ঞানীরা এটি গবেষণা করে দেখতে ভীষণ আগ্রহী। ন্যাশনাল সেন্টার ফর এটমোসফেরিক সায়েন্সের বিজ্ঞানী প্রফেসর স্টিভেন মবস বলেন, “অগ্নুৎপাতের সময় যখন ঘনিয়ে আসতে থাকে, আগ্নেয়গিরিটি তখন সামান্য ফুলে-ফেঁপে উঠে। এর ফলে তার ভেতর থেকে প্রচুর গ্যাস বেরিয়ে আসতে পারে। তখন এর ভবিষ্যৎ অগ্নুৎপাতের ব্যাপারে একটা ইঙ্গিত পাওয়া সম্ভব।”
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত আমরা ঠেকাতে পারবো না। ফলে ভবিষ্যতে সেখানে অগ্নুৎপাতের ঘটনা ঘটবে এবং এর ফলে বিমান চলাচলে কিছুটা বিশৃঙ্খলা ঘটবেই। কিন্তু কখন হবে, কতো বড়ো আকারে হবে- এসব জানা থাকলেই আগে থেকে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা সম্ভব।
বিজ্ঞানের আসর পরিবেশন করেছেন মিজানুর রহমান খান।