সুন্দরবনে শান্তি ফেরালেন যে সাংবাদিক

Date:

Share post:

গত বছর ২৮শে ‘র রাত। সুন্দরবনের জয়পুটিয়া ভাড়ানির এক গোপন জায়গায় ওঁত পেতে আছে র‍্যাপিড শন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)-এর একটি ইউনিট।

তারা অপেক্ষা করছে একদল জলদস্যুর। তবে তারা কোন অভিযান চালাচ্ছে না।

তারা অপেক্ষা করছে কখন এই দস্যুদল এসে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে।

একই সময়ে সুন্দরবনের অন্যদিকে ঘটছিল ভিন্ন এক ঘটনা। দুর্ধর্ষ জলদস্যু দল মাস্টার বাহিনীর প্রধান কাদের মাস্টার এবং অন্যান্যদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছিলেন একজন সাংবাদিক।

দস্যুদের মন দুলছে অজানা শঙ্কা আর নামহীন সন্দেহে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের শান্ত করলেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ িবেদক মোহসীন-উল হাকিম।

পরদিন ভোরবেলা দেখা গেল র‍্যাবের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে একটি লার।

কাছে ভেড়ার পর মোহসীন-উল হাকিমের পেছনে ট্রলার থেকে একে একে নেমে এলো নয় জন জলদস্যু ও তাদের নেতা কাদের মাস্টার।

বাংলাদেশে এই প্রথম একটি দস্যু দল বিনা রক্ততে স্বেচ্ছায় নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে তুলে দিল।

সাথে জমা দিল ৫১টি আগ্নেয়াস্ত্র। আর পাঁচ হাজারেরও বেশি গুলি।যমুনা টিভির জন্য রিপোর্ট করছেন মোহসীন-উল হাকিম।

ঠিক এর দু’দিন পর মংলায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁনের হাতে অস্ত্র সমর্পণ করে দলটি।

সারা দেশ জানতে পারলো সুন্দরবনের জলদস্যু দমনের রোমাঞ্চকর ঘটনার একজন নায়ক মোহসীন-উল হাকিম।

“এটা আত্মপ্রচারের বিষয় না। সাংবাদিক হিসেবে আমার মনে হয়েছে প্রতিদিনের খবর জোগাড়ের বাইরে যদি কিছু করতে পারি, যাতে দেশের মানুষের কোন উপকার হয়!” বিবিসির সাথে এক আলাপচারিতায় বলছিলেন তিনি।

আর সেই পথের সন্ধান দিলেন গাবুরার াসী। তিনি তখন দেশ টিভির সাংবাদিক।

দু’হাজার নয় সালের মে মাসে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় আইলা বিধ্বংসী শক্তি দিয়ে তছনছ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল।

অন্যান্য সাংবাদিকদের মতোই সেই ঝড়ের খবর সংগ্রহ করতে মোহসীন-উল হাকিমও গিয়েছিলেন বাগেরহাটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলির একটি গাবুরায়।

কিন্তু তিনি অবাক হলেন যখন গাবুরার মানুষজন তাকে জানালো যে ঝড়ে তাদের ক্ষতি তারা হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবেন। অস্ত্র ও গুলিগোলা সমর্পণের জন্য তৈরি হচ্ছে এক জলদস্যু দল।

কিন্তু ঝড়ের চেয়ে মারাত্মক এক ঝড় তাদের জীবনকে লণ্ডভণ্ড করছে প্রায় প্রতিদিন। তার নাম জলদস্যু।

“সেইবারই প্রথম বুঝতে পারলাম জোয়ারে মানুষের বাড়ি ডুবে গেছে, চারিদিকে শুধুই ধ্বংসের চিহ্ন। কিন্তু সেটাকেও তারা বড় সমস্যা বলে ভাবছে না। তারা আমাকে বললেন, আমরা আর পারছি না। ভাই, যেভাবেই হোক জলদস্যু ঠেকানোর জন্য কিছু একটা করুন।”

কথাটা মি. হাকিমকে এতটাই ধাক্কা দিয়েছিল যে তিনি এরপর থেকে জলদস্যু সমস্যা সম্পর্কে খোঁজখবর করা শুরু করেন। ঐ অঞ্চলে শুরু করেন যাতায়াত।

এরপর ২০১০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো যোগাযোগ করতে সক্ষম হন মোতালেব বাহিনীর প্রধান মোতালেবের সঙ্গে।

তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন দস্যুতা ত্যাগ করতে।

গোড়াতে কিছুটা নিমরাজি হলেও মোতালেব পরে পিছিয়ে যায়। এক সময়ে সে র‍্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধেৰ প্রাণ হারায়।

“কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। এরপর বহু াতের সঙ্গে একে একে আমার আলাপ হয়। আমি বোঝার চেষ্টা করি তারা ঠিক কী ভাবছে। তারা আমাকে বলে যে আত্মসমর্পণ করলে র‍্যাব তাদের মেরে ফেলবে। আমিও বেশ নরমভাবেই বিষয়টাতেই এগিয়ে যেতে থাকি।”

ইতোমধ্যে মি. হাকিম যোগ দিয়েছেন যমুনা টিভিতে। সেখানে তিনি নিয়মিতভাবে সুন্দরবনের জলদস্যুদের ওপর রিপোর্ট প্রচার শুরু করেন।পুনর্বাসন চাহিদা সম্পর্কে জলদস্যুদের মতামত নিচ্ছেন মহসীন-উল হাকিম।

সুন্দরবনের আশেপাশে লক্ষ লক্ষ মানুষ কতখানি আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন সেই কাহিনী তুলে ধরতে থাকেন।

“এপর্যন্ত আমি সুন্দরবন গেছি প্রায় ১০০ বার। ফলে গোটা অঞ্চল যেমন আমার চেনা হয়ে যায়। তেমনি জলদস্যুরাও আমাকে চিনতে পারে। আমার সম্পর্কে জানতে পারে। তাদের সাথে আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম, মোবাইল ফোনে কথা বলতাম। ফলে তারাও আমার আস্থা রাখতে শুরু করে।”

“পুরো বিষয়টাকে আমি পেশাদারিত্বের সঙ্গে হ্যান্ডল করার চেষ্টা করেছি। রিপোর্টিং-এর সময় কোন পক্ষ নেইনি। কোন আইন ভঙ্গ করিনি। প্রতিবার জঙ্গলে ঢোকার সময় আমি কর্তৃপক্ষকে আগাম জানিয়ে রাখতাম”, বলছিলেন তিনি, “আত্মসমর্পণের আলোচনা চালানোর সময়ও আমি দস্যুদের কোন ধরনের প্রতিশ্রুতি দেইনি। কোন ধরনের সুবিধে নেইনি তাদের কাছ থেকে। ফলে তারা আমাকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে। আমার জন্য এটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”

কিন্তু আত্মসমর্পণ প্রশ্নে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা সরকারের তরফ থেকে গোড়ার দিকে খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি।অন্ধকারের জীবন সম্পর্কে সাবেক আলম বাহিনীর প্রধান আলম সরদার।

ইতোমধ্যে জলদস্যু দমনে সরকার তৈরি করেছে এক বিশেষ টাস্কফোর্স। র‍্যাব, কোস্টগার্ড, পুলিশ এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো সুন্দরবন অঞ্চল জুড়ে জাল ফেলেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে একের পর এক নিহত হচ্ছে দস্যুরা। তাদের আয়ে টান পড়েছে।

সাঁড়াশি অভিযানের মুখে তাদের তৎপরতার জায়গা ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে।

এই পটতে আত্মসমর্পণ প্রশ্নে প্রথম অগ্রগতি হয় ২০১৫ সালে। মাস্টার বাহিনী দলনেতা কাদের মাস্টার তাকে জানালেন যে তিনি জঙ্গল ছাড়তে চান।

এ সম্পর্কে মোহসীন-উল হাকিম যমুনা টিভিতে যে রিপোর্ট প্রচার করেন তারপরই নড়েচড়ে বসে সরকার। তারা মি. হাকিমের সাথে যোগাযোগ করে।

বরিশাল-ভিত্তিক র‍্যাব- এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মোঃ আনোয়ারুজ্জামান মি. হাকিমের ক্যাডেট কলেজের সহপাঠী।

সেই সূত্রে র‍্যাব-৮ এর সাথে তার একটি কার্যকর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

এরপর তিনি বেশ কয়েকবার বনের ভেতরে ঢুকে মাস্টার বাহিনীর সাথে কথা

আত্মসমর্পণের জন্য তাদের লিখিত আবেদনপত্র সংগ্রহ করে সরকারের হাতে তুলে দেন।

দীর্ঘ এক বছর আলোচনার পর আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে।

মি. হাকিম নিজে বনের ভেতরে মাস্টার বাহিনীর আস্তানায় গিয়ে তাদের বের করে আনেন এবং র‍্যাবের হাতে তুলে দেন।

“এই আত্মসমর্পণের পরিণতি সম্পর্কে অন্য গ্রুপগুলোর মনে ভয় ছিল। তারা মনে করেছিল আত্মসমর্পণের পর মাস্টার বাহিনীর সবাইকে মেরে ফেলা হবে,” বলছিলেন তিনি, “কিন্তু সেটা যখন ঘটলো না। তখন অন্যান্য দলগুলো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলো।”

এরপর একে একে সুন্দরবন থেকে বেরিয়ে এল মজনু বাহিনী, ইলিয়াস বাহিনী, শান্ত বাহিনী, আলম বাহিনী, সাগর বাহিনী, খোকাবাবু বাহিনী, নোয়া বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, ছোটরাজু বাহিনী, আলিফ বাহিনী আর কবিরাজ বাহিনী।

প্রতিটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটলো মহসীন-উল হাকিমে মধ্যস্থতায়। জলদস্যুরা জঙ্গল ছাড়লো তারই হাত ধরে।

তার প্রতি সাবেক জলদস্যুদের গভীর আস্থা আর শ্রদ্ধার প্রকাশ, এক জলদস্যুর কথায়: “মোহসীন ভাই বললি পাঁচ তলা থিকি ঝাঁপ দিতি পারি। ওপর আল্লাহ নীচে এই ভাই।”

এসব বাহিনীর মোট ১৫০ জন জলদস্যু এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।

আত্মসমর্পণের সময় র‍্যাবের কাছে জমা পড়েছে প্রায় ২৪৭টি আগ্নেয়াস্ত্র।

এই অস্ত্রগুলোই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষ আর উপকূলে জেলেদের ঘুম কড়ে নিয়েছিল।

“এখনও দু’একটি দল সুন্দরবনে তৎপর রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এরাও নিশ্চই একসময় নিজেদের ভালটা বুঝতে পারবে,” বলছিলেন মোহসীন-উল হাকিম।

তাই আপাতত তিনি সন্তুষ্ট এই ভেবে যে আট বছর পরে হলেও গাবুরার গ্রামবাসীদের তিনি একটা সুখবর দিতে পারছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়েছি’ বক্তব্যটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার

‘২২৬টি মামলা হয়েছে, ২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়েছি’ বক্তব্যটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এই অডিও বক্তব্যের ফরেনসিক প্রমাণ...

বন‍্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ঘর বিতরণ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস

দেশের চারটি জেলায় গত বছরের বন‍্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ঘর বিতরণ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ...

আবাসিক হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় একটি আবাসিক হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। কলকাতা পুলিশ মঙ্গলবার এ কথা জানিয়েছে। বড়বাজার...

আমরা রাষ্ট্রের দায়িত্বে যাই আর না যাই আপনাদের সাথে আছি, জামায়াত ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান

জামায়াত ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, দেশ আমাদের সবার। সুতরাং এ দেশে আমরা মর্যাদা ও শান্তির সাথে...