জমিতে ফসল নেই, ঘরে চাল নেই, এলাকায় কাজ নেই- কী করবেন উত্তরাঞ্চলের বন্যার্তরা?

Date:

Share post:

ধরলা নদীর পানি যখন বাড়তে শুরু করে, ইদ্রিস আলী সেদিন দোকান ফেলে ঘরেই ছিলেন। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রবল স্রোতের সঙ্গে পানি বাড়তে শুরু করে।

ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দেখেন কোমর সমান পানি হয়ে গেছে। সেই পানি থেকে বের হতে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার স্ত্রী, মেয়ে আর দুই ছেলে। তারা বেচে আছে কিনা তাও তিনি জানতেন না।

দুইদিন পর স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। একদিন পরে খোঁজ পান দুই ছেলের।

কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা ইউনিয়নের সারডোবের আরডিআরএস বাজারের কাছে বসে ইদ্রিস আলী যখন এই বর্ণনা দিচ্ছেন, তার পেছনেই পড়ে আছে তার দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা বাড়িটি। তার স্ত্রী বাড়ির ভেতর থেকে সংসারের টুকিটাকি খুঁজে বের করছিলেন।

তারপরেও ইদ্রিস আলী অনেকের তুলনায় হয়তো ভাগ্যবান। যেমন মোঃ আলীর পুরো বাড়িটি পানিতে ভেসে গেছে। তার সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়, তখন তিনি সবেমাত্র একটি নৌকা নিয়ে বাড়ির টিন-কাঠ কুড়িয়ে ফিরেছেন।

তিনি বলছেন, ”পানিতে সবকিছু ভাসায়ে নিয়ে গ্যাছে। ঘরটা সবে জাগিছে। এখন ইট কাঠ খুঁজি বের করার চেষ্টা করতেছি। নাহলি ঘর তুলিমু কেমনে?”

মোঃ আলীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার ঘরের দিকে হাঁটছি। ঘর বলতে, সরকারি রাস্তার উপর ত্রিপল টাঙ্গিয়ে থাকার ব্যবস্থা।বন্যায় উদ্বাস্তু হয়ে আরো অনেক পরিবারের মতো এই পরিবারটিও রাস্তার উপর আশ্রয় নিয়েছে। পাশে যেখানে তাদের বাড়ি ছিল, সেখানে এখনো জমে আছে পানি।

তার স্ত্রী আজিমুন্নেসা জানালেন, এই রাস্তা ধরে একঘণ্টা হাঁটলেও এরকম চাপড়ার শেষ হবে না। এই রাস্তাতেই পাঁচশোর বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

ত্রিপলের নীচে ছোট একটি চাপড়ার মধ্যে একটি চৌকি। পাশেই থালাবাসন, সংসারের নানা জিনিসপত্র সাজানো। সেখানেই রান্না বান্না। বাথরুম বলতে কিছু নেই।

প্রতিবছরই কুড়িগ্রামে কমবেশি বন্যা হয়। নদীর পানি বাড়লে চরের নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়।

কিন্তু এবছরের বন্যা যেভাবে হয়েছে, তা তাদের কাছেও অপরিচিত। একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে ধরলা নদীর যতদূরে আমি গিয়েছি, সবখানেই বন্যার বিধ্বংসী ছাপ দেখা গেছে।

বড় বড় গাছ শেকড়সহ উপড়ে পড়ে আছে। কলাবাগান, ধানক্ষেত, সবজি ক্ষেত নষ্ট। রাস্তাঘাট ভেঙ্গে গেছে, ঘরবাড়ি ঘূর্ণিঝড়ের মতো বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে।

ইঞ্জিন নৌকার মাঝি জব্বার হোসেন জানালেন, জন্মের পর থেকেই তিনি এই নদীর পাশে বড় হয়েছেন। এর আগেও অনেক বন্যা দেখেছেন। কিন্তু এত কম সময়ে এত বেশি ক্ষতি আর কোন বন্যায় হয়নি।

কৃষক আমিনুল হোসেন জানালেন, কয়েকদিন ধরেই পানি আস্তে আস্তে বাড়ছিল। কিন্তু শুক্রবার (১১ আগস্ট ২০১৭) প্রবল স্রোত এতে বাড়িঘর সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মানুষজন যে ঘরের জিনিসপত্র বের করে নিয়ে যাবে, সেই সুযোগও পায়নি।

আমেনা বলছেন, ”আমরার সব আত্মীয়স্বজনের বাড়িত পানি উঠছে। কারো বাড়িতে গিয়ে যে উঠবো, তার উপায় নেই। কোন বেলা খাইয়ে, না খাইয়ে তাই এখানেই আছি। বৃষ্টি হলি উঠি বসি থাকা লাগি।” সারডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার। একেকটি রুমে পাঁচ সাতটি করে পরিবার। সেখানে এই বেঞ্চের উপর শুয়ে আছে দশ বছরের সুমন।

তার মা, নুরিয়া জানালেন, বন্যার সময় ঘর থেকে বের হতে গিয়ে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সুমন। তিনদিন জ্বর ছিল। এখন শুধু শুয়েই থাকে। কিন্তু তাতে নিয়ে শহরে ডাক্তারের কাছে যাবেন, সেই সামর্থ্য নেই।

আব্দুল জব্বার বললেন আরেক সমস্যার কথা। গরুর খাবারের জন্য খড় খুঁজতে হয়। নতুন পাঠ উঠেছে। সেগুলোর পাটকাঠি ঠিকঠাক করতে হয়। কিন্তু বন্যার কারণে সাপগুলো এখন স্থলে আশ্রয় নিয়েছে। পাটের স্তূপ ধরতে গিয়ে সাপ, নাড়ার মধ্যে সাপ।

ঘরে খাবার নেই, থাকার জায়গা নেই। কিন্তু তারচেয়েও যেন তাদের বেশি চিন্তা ক্ষেতের ফসল আর গরুর থাকার জায়গা নিয়ে।

এই গবাদি পশুগুলোর এখন তাদের কাছে মূল্যবান সম্পদ। তাই নিজেদের খাবার না মিললেও, তারা গরুর খাবারের জন্য এর ওর কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

ক্ষেতে বালু জমে আছে। কয়েকদিন আগে বোনা আমনের উপর থেকে পানি সরে গেছে, কিন্তু তার উপর জমে আছে নদীর পলি। এই জমিতে আবার কবে ধান চাষ করতে পারবেন, তা কারো জানা নেই।

তাই বলে তারা অবশ্য বসেও নেই। কোদাল দিয়ে ক্ষেতের বালু সরাতে শুরু করেছেন অনেকে। মনোয়ার হোসেন বলছেন, ”এই জমিই আমাদের সব। এটা যদি আটকে পড়ে থাকে, খাবো কি, চলবে কিভাবে।” মনোয়ার হোসেন আশা করছেন, বালু সরাতে পারলে, আলু লাগাবেন।

যাদের জমি কিছুটা ভালো আছে, তারা পড়েছেন বীজ সংকটে। সরফুদ্দিনের জমি কিছুটা উঁচু থাকায় পলি কম পড়েছে। কিন্তু তার আমন ধানের সব চারা নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলছেন, ”ধান লাগানোর সময় শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু এখনো কয়েকদিন সময় আছে। কুড়িগ্রামের কোথাও ঘুরে বীজ পাইনি।”

রয়েছে ত্রাণের অপ্রতুলতাও। দশ কেজি করে চাল, কিছুটা চিড়া, মোমবাতি ইত্যাদি দেয়া হলেও তার সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার মোক্তার হোসেন বলছেন, ”আমার এখানে মোট ভোটার আছে ২৪০০ বেশি। কিন্তু প্রথম দিন ত্রাণ পেয়েছি ১১৫জনের জন্য, দ্বিতীয় দিন ৬০ জনের জন্য। তার উপর আনার খরচ আছে যেটুকু আনি, তা আরো অনেকের মধ্যে ভাগ করে দিতে হয়। তাতে তো কুলানো যাবে না। তাই এই বন্যা আসার পর এখন মানুষের কাছেও গালমন্দ শুনতে হচ্ছে।”

তবে কুড়িগ্রামের এই প্রত্যন্ত চরের মানুষ শুধু ত্রাণের আশায় বসে নেই। ঘরবাড়ি ভেঙ্গে যাওয়ায় সেটাই তারা আগে ঠিক করার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু গায়ে খাটার কাজ করবেন সেই সুযোগও নেই। কারণ এখানকার প্রায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। কাজ করার অনেক লোক আছে, কিন্তু কাজ দেয়ার লোক নেই।

কিন্তু জমিতে ফসল নেই, ঘরে চাল নেই, এলাকায় কাজ নেই। কি করবেন এখন? উত্তর পেলাম আজিমউদ্দিনের কাছে।

”ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামি চলি যাবো। যেথায় কাজ আছে, সেথাই চলি যাবো। রিজিক যেতা লেখা আছি, সেথাই হবি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আবারো এস আলমে আগুন 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় এস আলম গ্রুপের চিনির গুদামের পর এবার তেলের মিলে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের...

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...