উনিশশো একষট্টি সালের জুন মাসে বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিভাধর ব্যালে ড্যান্সারদের অন্যতম রুডল্ফ নুরেয়েভ সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ ত্যাগ করে পশ্চিমা বিশ্বে চলে আসেন।
সেই ঘটনাটি খুব কাছে থেকে দেখেছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একজন বিশিষ্ট সংগঠক ভিক্টর হখহাউজার।
তিনি বলছিলেন, নুরেয়েভের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ছিল বিশাল। “বিশাল ছিল তার ক্যারিজমা। যে মুহূর্তে তিনি স্টেজে উঠতেন, পুরো স্টেজটি তখন একেবারেই বদলে যেত,” তিনি বলছিলেন, “তার সৃষ্টি করা বিশেষ ধরনের নাচ, নতুন ধরনের মুভমেন্ট – এগুলো এর আগে আমরা কখনো দেখিনি। এমনকি তার পরেও এটি আর দেখা যায়নি।”
ভিক্টর হখহাউজার লন্ডনে থাকেন। কয়েক দশক ধরে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পশ্চিমা দেশগুলোতে সোভিয়েত শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। তিনি প্রথমবারের মতো রুডল্ফ নুরেয়েভের নাচ দেখেন লেনিনগ্রাদে। তখন তার ব্যালে কোম্পানির নাম ছিল কিরভ থিয়েটার। এখন অবশ্য এটি বিপ্লব-পূর্ব নামটিই ফিরে পেয়েছে – মারিনস্কি ব্যালে।
তিনি বলেন, “সেই সময়ে আমি অনেকবার সোভিয়েত রাশিয়ায় গিয়েছি। নিয়মিতভাবে কিরভ থিয়েটারে যেতাম। দেখতাম নুরেয়েভ তাতে নাচছেন। সেই সময়ে রাশিয়া কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নকে লোকে চিনতো এসব বিখ্যাত ব্যালে নৃত্যশিল্পীদের মাধ্যমে। এটা নিয়ে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। সেই সময়টাতেই আমি দেখেছিলাম তিনি কতটা বিখ্যাত ছিলেন।”
তেইশ বছর বয়সী নুরেয়েভের নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি প্রথমবারের মতো কিরভ থিয়েটারের বিদেশে সফরের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু নুরেয়েভের ব্যাপারে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের বেশ সন্দেহ ছিল। তিনি একজন সমকামী, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, কখন কি করে ফেলেন তা বোঝা মুশকিল। অবশ্য তার এইসব বৈশিষ্টের জন্যই নুরিয়েফকে স্টেজের মধ্যে আলাদা করে চেনা যেত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের মন গলেছিল। এবং ১৯৬১ সালের জুন মাসে রুডল্ফ নুরেয়েভসহ কিরভ ব্যালেকে বিদেশে ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হয়। কিরভ কোম্পানির প্রথমে শো করার কথা ছিল প্যারিসে। তারপর তাদের যাওয়ার কথা লন্ডনে। কিন্তু ১৯৬১ সালের ১৬ই জুনের মধ্যেই তাদের ব্যালে অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।
ভিক্টর হখহাউজার বলছিলেন, “তারা সবাই লন্ডনে আসছিলেন। তাদের মধ্যে নুরেয়েভও ছিলেন। বিমানবন্দরে গিয়ে দেখলাম সেখানে বহু সাংবাদিক হাজির হয়েছেন। সাংবাদিকরা সেখানে যাবেন সেটা জানতাম। কিন্তু তারা যে এত সংখ্যায় যাবেন, সেটা টের পাইনি। তারাই আমাদের জানালেন যে ঘন্টা কয়েক আগে নুরেয়েভ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তিনি পক্ষত্যাগ করবেন।”
পক্ষত্যাগ করার মানে হলো কমিউনিজম ছেড়ে পুঁজিবাদের ঘরে চলে আসা। অর্থাৎ সোভিয়েত রাশিয়া ছেড়ে পশ্চিমে চলে আসা। এটা ছিল খুবই গুরুত্ত্বপুর্ণ এক সিদ্ধান্ত। যেদিন কিরভ কোম্পানির প্যারিস থেকে লন্ডনে আসার কথা, সেই দিন সকালে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় যে নুরেয়েভকে বিদেশে রাখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা চলছিল। নুরেয়েফ এটা টের পেয়ে সেই দিনই সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নেন।
পশ্চিমা বিশ্বে নুরেয়েভের এই সিদ্ধান্ত কমিউনিস্ট জোটের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণার সুযোগ তৈরি করে দেয়। কিন্তু ভিক্টর হখহাউজার বলছেন, প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তার আগ্রহ ছিল শিল্পের প্রতি, তার নিজের খ্যাতির প্রতি, তার নতুন বন্ধুদের প্রতি। কমিউনিজম বা ক্যাপিটালিজম — এসব তার জন্য গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না।সোয়ান লেক-এর একটি দৃশ্যে রুডল্ফ নুরেয়েভ
“তিনি যে নিজের দেশ ত্যাগ করেছিলেন তার সাথে কোন ধরনের রাজনীতিরই কোন সম্পর্ক ছিল না। তিনি যখন লন্ডনে আসার জন্য মনে মনে তৈরি হচ্ছিলেন তখন তাকে বলা হলো মস্কো ফিরে যেতে। সেটিই বোধ হয় ছিল পক্ষত্যাগের সবচেয়ে বড় কারণ।”
যাহোক, ১৯৬২ সালে নুরেয়েভের স্বপ্ন সফল হলো। তিনি লন্ডনের রয়্যাল ব্যালেতে যোগদান করলেন। সেখানে তিনি নাচের সঙ্গী হলেন প্রিমা ব্যালেরিনা মার্গো ফনটেইনের। তাদের এই জুটিকে দর্শক ভালভাবে গ্রহণ করলো। ধ্রুপদী ব্যালের যেসব আবেগঘন ব্যাখ্যা এই জুটি তৈরি করেছিল তা মানুষকে মুগ্ধ করলো।
কিন্তু ১৯৬০-এর শেষের দিকে, রয়্যাল ব্যালের সাথে নুরেয়েভের সম্পর্কে ভাঙন ধরে। শুধুমাত্র রোমান্টিক চরিত্রের মধ্যে তাকে আবদ্ধ করে রাখাটা তিনি একদম মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ কামনা করতেন। সারা বিশ্ব তিনি ঘুরে দেখেছেন। যেখানে সম্ভব সেখানে তিনি নাচ দেখিয়েছেন। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৯৮০ সালের মাঝমাঝি পর্যন্ত ভিক্টর হখহাউজার রুডল্ফ নুরেয়েভের ওপর অনেকগুলো উৎসবের আয়োজন করে।
স্টেজের বাইরে নুরেয়েভের বদনাম ছিল একজন রাগী মানুষ হিসেবে। ব্যালে অনুষ্ঠানের শেষে বেশিরভাগ শিল্পী যখন বাড়ি চলে যেতেন, নুরেয়েভ তখন নাইটক্লাবে যেতেন। কিংবা বন্ধুদের ডাকতেন ডিনারে। তার প্রাণশক্তির ঘাটতি ছিল না। তার অতিথিরা ক্লান্ত হয়ে পড়েলেও নুরেয়েভের কোন ক্লান্তি ছিল না। তার শরীর যখন এসব আর সহ্য করতে পারছিল না, তখনও কাজের প্রতি তার ছিল অসাধারণ নিষ্ঠা।
এইডস-এ আক্রান্ত হয়ে রুডল্ফ নুরেয়েভ ১৯৯৩ সালে প্রাণত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৫৪ বছর। আর ভিক্টর হখহাউজার এখনও লন্ডনেই থাকেন। এখনও তিনি রুশ শিল্পীদের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন।