ট্রাম্প কি ভারতের হাত ছেড়ে দিলেন?

Date:

Share post:

ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রতিক সংঘাত, উত্তেজনা, শান্তি প্রক্রিয়া ও আগামী দিনের অনিশ্চয়তাগুলো নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য ডন। সেখানে সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সামরিক ও কূটনৈতিক সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্লেষণটি লিখেছেন করাচিভিত্তিক সাংবাদিক ও লেখক – জাহিদ হোসাইন। কালবেলা পাঠকদের জন্য সেটির বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো—

দক্ষিণ এশিয়ার দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে চার দিনের তীব্র সংঘাত যা সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিতে পারত, অবশেষে থেমেছে। মিসাইলের গর্জন থেমেছে, ্দুকের নলগুলো নীরব হয়েছে। মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির পর ও পাকিস্তান উভয়ই সংঘাত থেকে সরে এসেছে। যুদ্ধ হয়ত বন্ধ হয়েছে, তবে এই যুদ্ধবিরতির চারপাশে এখনও ঘনিয়ে আছে অনিশ্চয়তা।

ভারত এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে মূল বিধের বিষয়গুলো নিয়ে গঠনমূলক আলোচনায় বসার কোনো আগ্রহ দেখায়নি। বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র এই সামরিক সংঘাতের ফলাফল ভারতের কট্টর জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। বহু পাকিস্তানি শহরে একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ভারত যা চেয়েছিল, পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় প্রতিক্রিয়ায় তা ব্যর্থ হয়েছে।

ভারতের সবচেয়ে আধুনিক ৫টি যুদ্ধবিমান গুঁড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তান আধুনিক যুদ্ধ ইতিহাসে নজিরবিহীন এক কীর্তি গড়ে তোলে। এরপর ভারত আরও উসকানিমূলক পদক্ষেপ নেয়— পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটি ও শহরগুলোতে মিসাইল ও ড্রোন দিয়ে হামলা চালায়। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও আরও তীব্রভাবে জবাব দেয়।

এই চারদিনের সংঘাতে দুই দেশের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের সম্ভাবনা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, ওয়াশিংটন এবং অন্যান্য রাজীতে গুরুতর উদ্বেগের সৃষ্টি করে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন শুরু থেকেই দুই দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও, পরিস্থিতি আরও গুরুতর মোড় নেওয়ার সাথে সাথে কূটনৈতিক উদ্যোগও জোরদার হয়। ফলে আরও একবার বহির্র হস্তক্ষেপের মাধ্যমেই এই সংঘাত বন্ধ হয়।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, তার প্রশাসনের হস্তক্ষেপের কারণেই একটি পরমাণু যুদ্ধ এড়ানো গেছে। যদিও ভারত কোনো বাইরের চাপ মেনে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। ট্রাম্প কেবল দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে মার্কিন কূটনৈতিক মধ্যস্থতার প্রস্তাবই দেননি বরং শান্তিকে অর্থনৈতিক সম্পর্কের সাথেও যুক্ত করেছেন— ‘চুক্তি চাইলে বাণিজ্য হবে’ এই বার্তা হয়ত দুই পক্ষকেই ছু হটতে বাধ্য করেছে।

সম্ভবত এই প্রথমবারের মতো শান্তি কূটনীতিতে কোনও মার্কিন প্রশাসন বাণিজ্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করল। যদিও আপাতদৃষ্টিতে উত্তেজনা শেষ হয়েছে বলে ে হতে পারে, তবে ের সবচেয়ে অস্থির অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বর্ণিত অঞ্চলে শান্তি এখনও অধরা। ভারত এখনো ইন্দাস পানি চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি — যেটিকে পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে মনে করে।

ভারতের নরেন্দ্র মোদি এখনো তার আগ্রাসী ভাষণ অব্যাহত রেখেছেন। তিনি পানি প্রবাহ বন্ধ রাখা এবং কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে ভারতের সঙ্গে একীভূত করার পর মোদির মতে, কাশ্মীর নিয়ে আলোচনার দরকারই নেই — আলোচনা হলে তা হবে কেবল পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে।

মোদি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ এই কারণে যে, সাম্প্রতিক সংঘাতে কাশ্মীর ইস্যুটি আবারও আন্তর্জাতিক আলোচনায় উঠে এসেছে। কাশ্মীর এবং দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য ইস্যুতে মধ্যস্থতা করতে ইচ্ছুক বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মন্তব্য তাকে আরও ক্ষুব্ধ করেছে বলে মনে হচ্ছে, যা যুদ্ধবিরতি চুক্তির একদিন পর তার সর্বশেষ জনসভার ভাষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারত বরাবরই কাশ্মীরকে ‘দ্বিপক্ষীয় বিষয়’ বলে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।

বিতর্কিত ভূখণ্ডে কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সীমান্ত পার হয়ে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন মোদি। এটি ভারত সরকারের আরও এক উদ্বেগজনক সিদ্ধান্ত। বিশ্লেষকদের মতে, এটি সামরিক প্রতিক্রিয়ার সীমা আরও কমিয়ে এনেছে। মনে হচ্ছে, ২০১৯ ও সাম্প্রতিক অভিযানে ব্যর্থতা থেকেও মোদি সরকার কোনো শিক্ষা নেয়নি।

ভারতের তথাকথিত ‘পারমাণবিক যুদ্ধ সীমার নিচে’ যুদ্ধের নীতি দুই বারই পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ায় ধাক্কা খেয়েছে। পাকিস্তান তাদের প্রচলিত সামরিক সক্ষমতা দেখিয়ে ভারতের আগ্রাসন রুখে দিয়েছে। ২০১৯ সালে যেমন ভারতীয় বিমান গুলি করে নামানো হয়েছিল এবং একজন পাইলট বন্দি হয়েছিল, এবারও পাঁচটি যুদ্ধবিমান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সংঘাত ভারতের প্রচলিত সামরিক শক্তির দম্ভকে চূর্ণ দিয়েছে। পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর মোদী সরকার দ্বিমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। ভারত একদিকে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে, অন্যদিকে কূটনৈতিকভাবে ইসলামাবাদকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করার চেষ্টা করে। তবে ভারত এখানেও চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

২০১৯ সালের মতো এবার আর ভারত তার সামরিক পদক্ষেপের জন্য ওয়াশিংটন এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে সমর্থন পেতে পারেনি। এই সংঘাতে ট্রাম্পের নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত ছিল মোদী সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক ধাক্কা। যেহেতু ভারতকে বিশেষ করে ওয়াশিংটনের কৌশলগত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাই দিল্লি ভেবেছিল যে-কোনো পদক্ষেপেই ট্রাম্প তাকে সমর্থন দেবেন। ফলে ট্রাম্প মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় ভারতের ‘পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার’ পরিকল্পনায় ছেদ পড়ে।

অন্যদিকে, চীনের কূটনৈতিক সমর্থন ও সামরিক সহযোগিতা পাকিস্তানের মনোবল বাড়িয়ে দেয়। চীনের উন্নত প্রযুক্তি ও মিসাইল দিয়ে পাকিস্তান একটি সফল “সেন্সর-ফিউশন কিল” পরিচালনা করে — এটি ভারতের জন্য একটি শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক বার্তা।

তবে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সফল প্রতিরক্ষা দেখাতে পারলেও এখনই ের উল্লাসে ভেসে যাওয়ার সময় নয়। বরং, এটি প্রতিফলনের সময়। এই সংঘাত দেশের কিছু দুর্বলতাও প্রকাশ করে দিয়েছে। এই সংঘাতের মাঝে, আমাদের প্রধান উদ্বেগ ছিল আইএমএফ তার ঋণের পরবর্তী কিস্তি অনুমোদন করবে কিনা। ইসলামাবাদ বুঝেছে যে, দুর্বল অর্থনীতির নিয়ে সফলভাবে নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা কঠিন।

বর্তমানে চলমান যুদ্ধবিরতি পাকিস্তানকে তার অর্থনীতির উপর মনোযোগ দেওয়ার জন্য কিছুটা সময় দিয়েছে। একইভাবে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা যে অপরিহার্য তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত একটি জাতি এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত দেশকে অত্যন্ত দুর্বল করে তোলে সেটা স্পষ্ট করেছে। ফলে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি থেকে পাকিস্তানের অনেক শিক্ষা নেওয়ার আছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

প্রকৃতি ধ্বংস করাকে উন্নয়ন মনে করলে ভুল পথে চলছি : রিজওয়ানা

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উন্নয়ন হলে সেটা টেকসই...

টিউলিপকে ফেরাতে যে সিদ্ধান্ত নিল দুদক

ব্রিটিশ সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশে দুর্নীতি মামলার আসামি টিউলিপ সিদ্দিককে দেশে ফেরাতে প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নেওয়া হবে। বুধবার (১৪...

চবির সমাবর্তনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পঞ্চম সমাবর্তনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করেছে বিশ্ববিদ্যালয়...

চট্টগ্রাম বন্দর সেরা না হলে দেশের অর্থনীতি সেরা হবে না, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

চট্টগ্রাম বন্দর সেরা না হলে দেশের অর্থনীতি সেরা হবে না। এই বন্দরকে আধুনিক ও শক্তিশালী করা হবে বলে...