ওবায়দুল কাদের পলাতক থাকলেও তার ভাতিজা পরিচয়দানকারি আলমগীর হোসেনের দাপট এখন কমেনি। অনেক আপত্তি এমনকি কোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির মূল্যবান স্ক্র্যাপ তার হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে।
ঘুষের বিনিময়ে ৮০ কোটি টাকা মূল্যের স্ক্র্যাপ নামমাত্র মূল্যে তুলে দেওয়া হয়েছে। এখানে কোর্টের নিষেধাজ্ঞাকেও পাত্তা দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, বিপুল পরিমাণ ঘুষের বিনিময়ে শিডিউল বহির্ভূত মূল্যবান তামার তারও পাচার করার অভিযোগ উঠেছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি (বিসিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম সরকারের বিরুদ্ধে।
সাইফুল ইসলাম সরকার ওই ঘুষের টাকা ক্যাশের মাধ্যমে নেওয়ার পাশাপাশি নিজ এলাকা বগুড়ার একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের একাউন্টের মাধ্যমে নিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ন্যাশনাল ব্যাংক বগুড়া শাখার নিগাত সিমার হিসাব নম্বরে (১০১৪০০১৪৯৩৬৭০) ৩০ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ব্যাংকের পাশাপাশি নিকট আত্মীয় সুরুজ্জামান সরকার ও উজ্জল হোসেনের মাধ্যমে নগদ টাকা গ্রহণ করেন। কখনও কখনও নিজেই ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত তার বাসা এলাকার রেস্টুরেন্টে বসে লেনদেন করেছেন। এক ছবিতে ব্যাংকের কাউন্টারের সামনে টাকা বুঝে নিচ্ছেন তার ঘনিষ্ঠ উজ্জল হোসেন। পরে লাল রঙের ওই ব্যাগ নিয়ে বের হতে দেখা যাচ্ছে তাকে।
এমডির ঘনিষ্ঠ উজ্জল হোসেন (পিতা মোঃ রাজিব) বগুড়া সদর উপজেলার কর্নপুর গ্রামের বাসিন্দা। আর নিকটাত্মীয় সুরুজ্জামান সরকার বগুড়ার ফুলবাড়ি থানার মধ্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। সুরুজ্জামানকে (পিতা আকবর আলী) সকলেই এমডির ভাই বলেই জানেন। তবে আপন ভাই নাকি চাচা কিংবা জ্যাঠার ছেলে সুত্র নিশ্চিত করতে পারেনি।
ওবায়দুল কাদেরের ভাতিজা পরিচয় দিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো আলমগীর হোসেন (পিতা- আব্দুল খালেক) চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার খাদেমপাড়ার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। ওবায়দুল কাদেরের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে বলে বড়পুকুরিয়া স্থানীয়দের কাছে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আওয়ামী লীগের পুরো সময়টা জুড়ে ছিল তার রামরাজত্ব। তার ইশারা ছাড়া এমডি কোন কাজেই করতেন না। অভিযোগে প্রকাশ, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি স্ক্র্যাপ মালামাল হস্তান্তর না করতে ৮ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেয়। সেই নির্দেশনা অমান্য করে পরের দিনেই স্ক্র্যাপ সরবরাহ করেছেন সাইফুল ইসলাম সরকার।
আরমান হোসেন সোহাগ নামের একজন অভিযোগ করেছেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম সরকার, আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে ২৫ বছর ধরে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে কাজ করছেন। চাকরির সুবাদে অনিয়ম দুর্নীতি করে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার বিরুদ্ধে কোম্পানির স্থায়ী আমানত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে (পদ্মা ব্যাংক) রেখে ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়া, সরকারি গাছ বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ, কয়লা বরাদ্দের মাধ্যমে কমিশন গ্রহণ করা। বগুড়ার ফুলবাড়ি মহিলা কলেজের সামনে ৫ তলা ভবন, ঢাকার মিরপুর-২ নম্বর স্টেডিয়াম এলাকায় বিশাল সাইজের ফ্ল্যাট রয়েছে তার।
স্ক্র্যাপ বিক্রির ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। স্ক্যাপের সঙ্গে খনির ভেতর থেকে মূল্যবান অন্যান্য জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। লোকজন যাতে বুঝতে না পারে সে জন্য কাভার্ড ভ্যানে করে স্ক্র্যাপ সরিয়ে ফেলাসহ নানান দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
সাইফুল ইসলামের দুর্নীতির বিষয়ে ইতোমধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তে নেমেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। দুদকের দিনাজপুর জেলা কার্যালয় থেকে উপপরিচালক আতাউর রহমান সরকার স্বাক্ষরিত এক পত্রে সাইফুল ইসলাম সরকারের বিষয়ে তদন্ত নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওই চিঠিতে বেশ কিছু বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে তার কাছে। চিঠিতে বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা স্থায়ী আমানতের তথ্য, কয়লা খনি শ্রমিকদের বেড়শিট ও ছাতা প্রদানের বিষয়ে তথ্য, আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগের তথ্য, দিঘীপাড়া কয়লা খনির জরিপ কাজ, হাকিমপুর লোহা খনির ফিজিক্যাল স্ট্যাডি নামীয় প্রকল্প -২ ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রীয় প্রায় সকল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সরানো হলেও আওয়ামী লীগের সময় মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো সাইফুল ইসলাম সরকার রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে। কথিত রয়েছে তিনি যেমন নিতে জানেন, তেমনি উপরের দিকে ঢালতেও সিদ্ধহস্ত। যে কারণে অন্যান্য এমডিরা চলে গেলেন তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সরকারের পট পরিবর্তনের পর তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও উপতলার জোরে পার পেয়ে যাচ্ছেন। ২৫ আগস্ট খনি মুখে তার বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে ফুলবাড়ী-পার্বতীপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা। এরপর জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দেওয়া হলেও কোন কাজে আসেনি।
স্ক্র্যাপ টেন্ডার দুর্নীতির বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) আব্দুল মান্নান পাটোয়ারীকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। অতীতে দেখা গেছে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সাইফুল ইসলাম সরকারের বিষয়ে অনেকটা উদার পেট্রোবাংলা। তাকে বহাল রেখেই তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে।
ওই তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) আব্দুল মান্নান পাটোয়ারীকে বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা তদন্ত করে রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছি। এখানে লিমিটেড টেন্ডার করা হয়েছে, ওপেন টেন্ডার করলে বিষয়টি ভালো হতো। তবে বোর্ডে অনুমোদনের মাধ্যমে করেছে।
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রসঙ্গে বিসিএমসিএল এর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কাক কাকের মাংস খায়না বলে একটা কথা রয়েছে। আর সাইফুল ইসলাম সরকার ম্যানেজ ম্যান হিসেবে সবার সেরা। না হলে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া সব এমডি বিদায় হলেও তিনি এখনও বহাল থাকেন কি করে। আবার সুধা সদনের ঘনিষ্ঠ মফিজুল ইসলাম এই সময়ে এসে টেন্ডার পায় কি করে। তাও আবার গোপন লিমিটেড টেন্ডারে।
বিসিএমসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম সরকারকে একাধিক দফায় ফোন দিলেও রিসিভ করেন নি। এমনকি এসএমএস দিলেও সাড়া দেন নি।