ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের প্রভাব ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু’দেশের ওপর নির্ভরশীতা কাটিয়ে বিকল্প খুঁজতে হবে। দুই দেশ পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধে জড়ালে সম্ভাব্য ঝুঁকি মাথায় এখন থেকেই তৎপর হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতি সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বেশ কয়েকটি ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে। দুদেশ বড় আকারে যুদ্ধে গেলে যে সাপ্লাই লাইনগুলো আছে, সেগুলো আরও ব্যাহত হবে। বিশেষ করে সমুদ্রপথে সাপ্লাই লাইনগুলো যদি ব্যাহত হয় তাহলে আরও বড় ক্ষতি হবে।’
‘শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে পুরো দক্ষিণ এশিয়া ক্ষতির মুখে পড়বে। এই দুদেশের মধ্যে বড় আকারে যুদ্ধের সম্ভাবনা তেমন নেই। দুটি দেশেরই পারমাণবিক সক্ষমতা আছে। কিন্তু তাদের জনগণ বড় ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বলে মনে করি না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলব, তারা বড় যুদ্ধে জড়াবে না। হয়তো পাল্টাপাল্টি ওই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে’-যোগ করেন ড. ইমতিয়াজ।
সীমান্তে ভারতীয় নাগরিকদের বিএসএফ পুশইন করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার ঘটনায় ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘এখনি বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে দুদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং করতে হবে। এই মুহূর্তে ভারত সরকারের নজর পাকিস্তানের দিকে। তারপরও যেহেতু পুশইন হচ্ছে তাই এক্ষেত্রে বসে থাকলে চলবে না।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘ভারত পাকিস্তানের কয়েকটি জঙ্গি আস্তানায় হামলা চালালেও কোনো সামরিক স্থাপনায় হামলা করেনি। যুদ্ধ বলতে যেটা বোঝায়, সেটা এখনো শুরু না হলেও উভয় দেশেরই কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এটি বেশি দূর গড়ালে যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকবে। তবে আশা করব, দুই দেশ যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে যাবে না।’
সাবেক এই কুটনীতিক মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ অবস্থা বেশি দিন চললে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে এই দুটি দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যে চেষ্টা চলছে তা আর এগোবে না। কারণ তারা বাংলাদেশের দিকে নজর দেওয়ার পরিবর্তে যুদ্ধের দিকেই নজর থাকবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যে চেষ্টা চালাচ্ছে, সেটাও হবে না। কারণ পশ্চিমা বিশ্বেরও নজর থাকবে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের দিকে। তাই এ অবস্থায় এখন বাংলাদেশের উচিত হবে নিজেদের উন্নয়নে দৃষ্টি দেওয়া। নিজেদের মধ্যে যেসব দুর্বলতা আছে সেগুলো কাটিয়ে ওঠা।
ভারত পাকিস্তান সংঘাতের আঁচ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবধারিতভাবে পড়বে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ভারত আমাদের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী দেশ। পাকিস্তানের সঙ্গেও আমরা বাণিজ্য উন্মুক্ত করার একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এই ধরনের যুদ্ধের ফলে ভারত মহাসাগরের অবস্থা কী হয় জানি না। আকাশসীমা তো ইতোমধ্যে বন্ধই আছে। এখন যদি সমুদ্রপথের ওপর এটার কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাহলে বাণিজ্য খরচও অনেক বাড়বে।’
‘বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চান, তারাও কিন্তু একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বেন। এই ধরনের যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, এই অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে আসার ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কিছুটা চিন্তা করবেন’-শঙ্কার সঙ্গে বলেন ড. মোস্তাফিজ।
এ বিষয়ে একই মত বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনেরও। তিনি বলেন, ‘সুতা, তুলাসহ যেসব পণ্য আমরা আমদানি করি, সেগুলো ঠিকভাবে উৎপাদন না হয়, তাহলে আমাদের সরবরাহ চেইনে একটা ব্যাঘাত ঘটবে। ফলে এখন থেকেই তার বিকল্প চিন্তা করতে হবে। যা হতে পারে চীন। আর যেহেতু ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কেও কিছুটা অবনতি আছে, তাই ব্যবসায়ীদের মাথায় বিকল্প চিন্তা রাখা উচিত।