কাপ্তাই লেকের জন্য ভিটেছাড়া হওয়া চাকমারা ভারতের অরুণাচল প্রদেশে আজও শরণার্থী

Date:

Share post:

অরুণাচলের দিয়ুনে বিজয়পুর শরণার্থী গ্রামে একটি চাকমা পারিবার

১৯৬০র দশকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাপ্তাই জলাধারের কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে যে চাকমারা ভারতে এসেছিলেন -তাদের একটা অংশ কেন এখনও পূর্ণ নাগত্ব পাননি, ভারতের পার্লামেন্টে সে প্রশ্ন উঠেছে।

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে ভারতে আসা এই চাকমারা ত ত্রিপুরা, মিজোরাম ও অরুণাচল প্রদেশ – উত্তর-পূর্ব ভারতের এই তিনটি রাজ্যে থাকেন।

ত্রিপুরা ও মিজোরামে তারা সব ধরনের নাগরিক সুযোগসুবিধা পেলেও অরুণাচলে তারা এখনও প্রায় শরণার্থীর জীবনই যাপন করছেন। তাদেরকে নাগরিকত্ব না-দেওয়ার ব্যাপারে সে রাজ্যের সব রাজনৈতিক ও এককাট্টা।

কিন্তু কেন অর্ধশতাব্দীরও বেশি ভারতে থাকার পরও কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সব নাগরিক অধিকার দেবে না, এ সপ্তাহেই পার্লামেন্টে সে প্রশ্ন তুলেছেন ত্রিপুরা থেকে াচিত সিপিএমের এমপি জিতেন্দ্র চৌধুরী।

কিন্তু লোকসভায় উপস্থিত অরুণাচলের কংগ্রেস এমপি নিনং এরিং সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তাবের তুমুল বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, স্থানীয় উপজাতিদের জমিজমা আর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই চাকমাদের নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব নয়।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, অরুণাচলের বিজেপি এমপি কিরেন রিজিজু নিজেও সে সময় পার্লামেন্টে, কিন্তু অরুণাচলে বসবাসকারী চাকমাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্নে তিনিও নীরব ছিলেন।

আসলে যদিও বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিম ছাড়া সব ধর্মের লোককে ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে বিজেপির বর্তমান সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ – অরুণাচলে চাকমাদের ক্ষেত্রে সেই সুবিধে দিতে তীব্র আপত্তি সে রাজ্যের কংগ্রেস বা বিজেপি, সব দলেরই।

ফলে ভারতের সবচেয়ে পূর্বপ্রান্তের রাজ্য অরুণাচলে গত পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে বেশ কয়েক হাজার চাকমা আজও শরণার্থীর মতো দিন কাটাচ্ছেন।

সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তাদের কারও কারও ভোটাধিকার লেও এই চাকমাদের নেই কোনও আধার কার্ড বা জাতীয় পরিচয়পত্র – কিংবা জমিজমা কেনার অধিকার।

ছবির কপিরাইট গেটি ইমেজেস
Image caption পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই লেকের একাংশ

কেন ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন চাকমারা?

এখনকার বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে হাজার হাজার চাকমা ভারতে এসেছেন মূলত দুটো কারণে। এক, ১৯৬২তে কমিশন করা কাপ্তাই লেকের জন্য ভিটেছাড়া হয়ে আর দুই, ১৯৭২-য়ে শান্তিবাহিনী গঠিত হওয়ার পর তাদের ্ধে সেনা অভিযান থেকে পালিয়ে প্রাণে বাঁচতে।

গবেষকরা বলেন, কাপ্তাই লেকের কারণে ৬৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছিল, যার মধ্যে ২২ হাজার হেক্টরই ছিল কৃষিজমি। বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন প্রায় ১ লক্ষ উপজাতীয়, যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই ছিলেন চাকমা।

আশির দশকেও হাজারে হাজারে চাকমা সহিংসতা থেকে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় চলে আসেন। ১৯৮৭তে মাত্র দুসপ্তাহের মধ্যে ৪৫হাজার চাকমা শরণার্থী ত্রিপুরায় ঢুকে শিবিরে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন – এমন ঘটনাও ঘটেছে।

ভারতে আসা এই চাকমাদের অনেকেই আর কখনও পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে যাননি। তাদের ধীরে ধীরে পুনর্বাসন করা হয়েছে ত্রিপুরা, মিজোরাম ও অরুণাচলের মতো রাজ্যে।

ত্রিপুরার এমপি জিতেন্দ্র চৌধুরী বিবিসিকে বলছিলেন, “ত্রিপুরায় যে চাকমারা আছেন তারা তফসিলি উপজাতিভুক্ত বলে গণ্য এবং ভারতের নাগরিক হিসেবে সেখানে সব সুযোগ-সুবিধাই তারা পান। ত্রিপুরাতে তাদের কোনও সমস্যা নেই।”

“এমন কী মিজোরামেও িধানের ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী সে রাজ্যে চাকমাদের জন্য একটি অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল বা স্বশাসিত পরিষদ গঠিত হয়েছে। ফলে সেখানেও তাদের অধিকার সুরক্ষিত বলা যেতে পারে।”

“কিন্তু মুশকিল হল অরুণাচল প্রদেশকে নিয়ে। ওই রাজ্যে যে চাকমারা আছেন তাদের কখনেই অরুণাচল প্রদেশের সরকার নাগরিকত্ব দিতে রাজি হয়নি। আর যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের সবারই ছিল একই নীতি – আর এ কারণেই সেখানে চাকমারা আজ এত বছর পরেও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন”, বলছিলেন জিতেন্দ্র চৌধুরী।

ছবির কপিরাইট AFP
Image caption অরুণাচল প্রদেশে একটি সর্ষে ক্ষেতে কর্মরত চাকমা নারীরা

চাকমাদের নিয়ে কী সমস্যা অরুণাচলের?

চাকমাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্ন শুনলেই রীতিমতো ক্ষেপে ওঠেন অরুণাচল প্রদেশের কংগ্রেস এমপি ও বর্ষীয়ান ক নিনং এরিং। বিবিসিকে তিনি পরিষ্কার বলছেন, এটা কোনও মতেই মানা সম্ভব নয়।

মি এরিংয়ের যুক্তি, “একবার নাগরিকত্ব পেলেই এই চাকমারা স্থানীয় উপজাতিদের সর্বনাশ ডেকে আনবে। অরুণাচলের যারা পুত্র, তারা বংশপরম্পরায় যে জমিজমা চাষ করে এসেছেন সেটা চাকমাদের কাছে খোয়াবেন।”

অরুণাচলের উপজাতিদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধকে ‘রের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যই’ এটা প্রয়োজন – এবং ‘অরুণাচলে থাকতে হলে চাকমাদের শরণার্থী হয়েই থাকতে হবে’, এ কথা বলতেও কোনও দ্বিধা নেই মি এরিংয়ের।

অরুণাচল প্রদেশে যে সব রাজনৈতিক দলের প্রভাব আছে, তারাও সবাই এই যুক্তিতে একমত। অরুণাচল প্রদেশে ঢোকার জন্য ভারতীয়দেরও ইনার লাইন পারমিট লাগে – সেই পারমিট ছাড়াই চাকমারা রাজ্যে ঢুকেছিল, সে কথাও তারা মনে করিয়ে দেন।

বস্তুত চাকমারা অত্যন্ত পরিশ্রমী ও উদ্যোগী জাতিগোষ্ঠী বলেই যে অরুণাচলে তাদের নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, সেটা প্রকারান্তরে মেনে নিচ্ছেন জিতেন্দ্র চৌধুরীও।

বামপন্থী এই নেতা বলছিলেন, “এই চাকমারা হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও কঠোর পরিশ্রম করে অরুণাচলের কোনও কোনও এলাকায় একেবারে ভোল বদলে দিয়েছেন।”

“বিশেষ করে তিরাপ জেলায় চাকমারা তো দারুণ সাফল্য পেয়েছেন। সেখানে এখন চাকমাদের সংখ্যা স্থানীয় উপজাতিদের চেয়েও বেশি – এই ভয়েই কোনও দল তাদের ভোটাধিকার দিতে চায়নি। আজ পর্যন্ত তারা সেখানে জমিজমা কিনতে পারেন না” বলছিলেন তিনি।

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে ভিটেছাড়া হয়ে চাকমারা একদিন সুদুর অরুণাচল প্রদেশের বিজন প্রান্তরে এসে ফসল ফলিয়েছিলেন, নতুন বসত করেছিলেন – কিন্তু সেই সাফল্যই এখন তাদের নাগরিকত্বের পথে বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

পাকিস্তানের নিজ ঘরে মিলল নারী টিকটকারের মরদেহ, রহস্যজনক আলামত

টিকটকার সামিরা রাজপুতের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পাকিস্তানের ঘোটকির মুমতাজ শাহ মহল্লায় তার বাসভবনে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মৃতদেহটি পাওয়া...

রাষ্ট্রের প্রধান ৩ অঙ্গের সমস্যা আগে সমাধান করতে হবে: আইন উপদেষ্টা

রাষ্ট্রের প্রধান ৩ অঙ্গ- নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগের সমস্যা আগে সমাধান করতে হবে বলে মনে করেন...

বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আরও এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ জারিফ ফারহান (১৩) নামে আরও এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু...

লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তৎপর : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে গণ-অভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্রসহ সারা দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী...