প্রায় ৪০ বছর আগে ১৯৭৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর সর্বকালের জনপ্রিয় রেগে শিল্পী বব মার্লিকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিলো।
কি হয়েছিলো সেদিন, কিভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিলো- সেসব জানা গেলেও গত চার দশকে এটা এখনও জানা সম্ভব হয়নি যে কারা তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিলো। সেটা আজও রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে।
বব মার্লি জ্যামাইকা দ্বীপের রাজধানী কিংস্টন শহরের হোপ রোডের যে বাড়িটিতে থাকতেন তার পাশের বাড়িতেই থাকতেন ন্যান্সি বার্ক।
সেদিন শিল্পীর বাড়িতেই ছিলেন তিনি। কারণ তিনি ছিলেন মার্লির আর্ট ডিজাইনারের বান্ধবী।
সেসময় বব মার্লি ক্যারিবীয় দ্বীপটির রেগে সঙ্গীতের রাজধানী হয়ে উঠার পথে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, “বব মার্লির বাড়ির পরিবেশটা ছিলো খুবই মজার। প্রচুর মানুষ থাকতো। বেশিরভাগই ছিলো পুরুষ। তারা গানবাজনার সাথেই জড়িত ছিলো। কিছু বিদেশিও ছিলো। ছিলো অল্পবয়সী ছেলে মেয়েও। আর সবার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো বব মার্লি। সে ছিলো একটা চুম্বকের মতো। আমিও ওই বাড়িতে যাওয়া আসা করতাম। ওই বাড়িতে দেখতাম লোকজন কি করছে- হয়তো কেউ ফুটবল খেলছে আবার কেউ গান প্র্যাকটিস করছে।”
সেসময় জ্যামাইকা ছিলো দরিদ্র ও বিভক্ত একটি দেশ। দরিদ্র এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে তখন বিভিন্ন সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের মধ্যে প্রায়শই মারামারির ঘটনা ঘটছে।
আর প্রধানমন্ত্রী মাইকেল ম্যানলি ছিলেন বিভাজন সৃষ্টিকারী এক ব্যক্তিত্ব। তখন রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সহিংসতার ঘটনা ক্রমশই বাড়ছিলো। বিশেষ করে নির্বাচনের সময়ে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কোথাও কোথাও সেনাবাহিনীর চৌকিও বসানো হয়েছে। বিশেষ করে বিরোধী লেবার পার্টির সমর্থক এবং ক্ষমতাসীন পিপলস ন্যাশনাল পার্টির সমর্থক – এই দুটো এলাকার মাঝখানে।
কখনো কখনো সেখানে উত্তেজনার সৃষ্টি হতো। একপাশ থেকে আরেক পাশে ছুঁড়ে মারা হতো পাথর, পানির বোতল। প্রায়শই গোলাগুলি ও বোমা হামলার ঘটনাও ঘটতো।
সংবাদপত্রগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই আগের দিনের খুনখারাবির খবর ছাপা হচ্ছিলো।
১৯৭৬ সালের সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিলো ডিসেম্বর মাসে। সেবার শিল্পী বব মার্লি প্রধানমন্ত্রী ম্যানলিকে সমর্থন করছিলেন। তবে এবার তিনি চাইছিলেন সরকারের কাছ থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিতে।
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করে তোলার লক্ষ্যে বব মার্লি প্রস্তাব দিলেন কিংস্টনে উন্মুক্ত এক কনসার্ট আয়োজনের। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ম্যানলি প্রকাশ্যে বব মার্লির প্রস্তাব সমর্থন করলেন এবং নির্বাচনের তারিখও পিছিয়ে দিলেন যাতে তিনি কনসার্টটিকে তার পক্ষের সমাবেশ হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন।
এরকম এক সময়ে ন্যান্সি বার্ক লন্ডনে এসেছিলেন। বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বব মার্লির বান্ধবী সিন্ডি ব্রেকস্পেয়ারকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরের ৩ তারিখে তারা দু’জনেই ক্যারিবীয় দ্বীপটিতে ফিরে যান। বাড়িতে ফিরেই তিনি চলে যান বব মার্লির বাড়িতে, তাকে দেখতে।
তিনি বলেন, “আমি যখন ৫৬ হোপ রোডের বাড়িটিতে গিয়ে পৌঁছাই তখন তার ফটক বন্ধ ছিলো। এটা অস্বাভাবিক ঘটনা। কারণ এই বাড়ির ফটক আমি এর আগে কখনো বন্ধ থাকতে দেখিনি।”
“বাড়ির সামনে কেউ ছিলো না। পুরো জায়গাটা ছিলো অন্ধকারে ঢাকা। আমি যখন বাড়িটির দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম তখনই ভয় পেয়ে গেলাম। মনে আছে, আমি তখন নিজেকে নিজে বলেছিলাম- থামো, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারপর আমি বাড়ির পেছনের দিকে যাওয়ার জন্যে অগ্রসর হই। যখন ভেতরে ঢুকি, দেখলাম সবাই সেখানে প্র্যাকটিস করছে।”
ন্যান্সি দেখলেন বাড়ির ভেতরে প্রায় প্রত্যেকে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। কেউ তাকে তার গাড়িটা সরিয়ে নিতে বললো যাতে মার্লির স্ত্রী রিটা তার গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যেতে পারেন। যখন সামনের ফটকটা খোলা হলো ঠিক তখনই আরেকটা গাড়ি হুট করে ভেতরে ঢুকে পড়লো, বলেন তিনি।
“আমি তখন মাত্র ঘুরে ঢুকেছি। কথা বলছি মিস ওয়ার্ল্ডের ব্যাপারে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেখানে মুহুর্মুহু গুলি হতে লাগলো। আমি তখন খুব কাছেই দাঁড়িয়ে, গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু কয়েক ফুট দূরেই এই গুলি চালানো হচ্ছিলো। আমি তখন হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম। বুঝতে পারছিলাম না আমি কি করবো। বাতিগুলো জ্বলছিলো। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে ওরা এখনই ঘরে ঢুকে আমাদেরকেও গুলি করতে পারে। ছোট্ট একটা শোওয়ার ঘর। আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলো না। বাচ্চারা বিছানার নিচে ঢুকে পড়লো। কিন্তু আমি কোথাও যেতে পারিনি।”
ন্যান্সি বার্ক জানান, তিনজন হামলাকারী বব মার্লির বাড়িতে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি করতে শুরু করে। তখন মার্লিসহ অন্যান্য শিল্পীরা মাটিতে শুয়ে পড়েন।
“তারপর আমি শুনতে পেলাম কেউ যেনো ডাকছে। নারী কণ্ঠ। আমি জানি না কে ডাকছিলো। তখন তিনি দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। তারপর হারিয়ে গেলেন অন্ধকারের ভেতরে। কিন্তু আমি ভেতরেই থেকে গেলাম। পুলিশ আসলো। আমি যখন ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছি, তখন দেখি বব পুলিশের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। তাকে এভাবে দেখতে পারাটা ছিলো আমার জীবনে দেখা অন্যতম সেরা একটি দৃশ্য। তাকে খুব ক্রোধান্বিত দেখাচ্ছিলো।”
তিনি জানান, “সেসময় এই ঘটনার ব্যাপারে বব মার্লি কিছু বলেন নি। আমিও তাকে কিছু বলিনি। বলার কিছু তো ছিলো না। আমি তখন আমার গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।”
বব মার্লি প্রাণে বেঁচে গেলেন। তার হাতে ও বুকে গুলি লেগেছিলো। তার ম্যানেজার ডন টেলরও আহত হয়েছিলেন। এছাড়া আর কেউ তেমন গুরুতর আহত হননি।
কারা এই হামলা চালিয়েছে, কারা এই বন্দুকধারীদের পাঠিয়েছিলো, তারা কেনো তাদের কাজ শেষ করলো না – এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলো না। ওই বন্দুকধারীদের কখনোই ধরতে পারলো না পুলিশ।
এর দুদিন পরেই আহত বব মার্লি কিংস্টনের উন্মুক্ত কনসার্টে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তার গান শুনতে সেদিন হাজির হয়েছিলো ৮০ হাজারেরও বেশি ভক্ত।
কিন্তু ন্যান্সি বার্ক সেদিন ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার সাহস পান নি। তিনি বলেন, “কেউ ধরা পড়েনি। কেউ জানে না কারা এটা করেছে। এতো কাছ থেকে আমি পুরো ঘটনাটি দেখেছি যে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি কখনোই জানতে পারিনি কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে এনিয়ে অনেক গুজব শুনেছি। আসলেই কি ঘটেছিলো সেটা জানা খুব কঠিন।”
বব মার্লি তার পরের দু’বছর স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন লন্ডনে। এসময় তিনি তার জীবনের কিছু শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত রচনা করেন।
১৯৮১ সালের মে মাসে তিনি ক্যান্সারে মারা যান, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। প্রতিভাবান এই শিল্পীর স্বল্প আয়ুর জীবনে তার মোট ১১টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে চারটিই ছিলো লাইভ অনুষ্ঠান।
ইতিহাসের সাক্ষী অনুষ্ঠানটি পরিবেশন করেছেন মিজানুর রহমান খান। শুনতে চাইলে উপরের অডিও লিঙ্কে ক্লিক করুন।