ক্রীড়াঙ্গনে ফিনিক্স পাখির মতো আবির্ভূত হলো আবার ভলিবল। ষাট-সত্তরের দশকে যে খেলাটা ছিল ফুটবলের জনপ্রিয়তার সমান, গত কয়েক দশকে তা মৃতপ্রায়।
সেখান থেকে সাইদ আল জাবির, সোহেল রানা, ইমরান হায়দারদের মতো কয়েকজন স্বপ্নবাজ তরুণের হাত ধরে সেই খেলাটির পুনরুত্থান হলো কাল। বাংলাদেশ জাতীয় ভলিবল দল ইতিহাস সৃষ্টি করে জিতল প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা। এশিয়ান সেন্ট্রাল জোনের এই আসরে মধ্য এশিয়ার শক্তিশালী দল কিরগিজস্তান বাধা হতে চেয়েছিল সেই উত্থানের পথে, পারেনি। ৩-০ গেমে উড়ে গেছে তারা। তাতে মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে যে উৎসব হয়েছে কাল, এমন উপলক্ষ খুব কমই এসেছে এই ক্রীড়া স্থাপনায়।
গত এসএ গেমসে কারাতে দলের সোনা জয় ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে কোনো আন্তর্জাতিক আসরে শিরোপার উৎসবে ভাসতে পারেনি এই ইনডোর। এখানে হ্যান্ডবল হয়েছে নিয়মিত, বাস্কেটবল হয়, ব্যাডমিন্টন, জুডোর আন্তর্জাতিক আসরও বসেছে। কিন্তু কোনোটিতেই কখনো চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি বাংলাদেশ। ভলিবলের মাত্র দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আসর ছিল এটি। আর তাতেই হলো এমন অর্জন। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই দর্শকের ঢল ছিল জাবির-মাসুদদের খেলা দেখতে। বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সই বারবার ফিরিয়ে এনেছে তাদের। কালও ফাইনাল শুরু হলো ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ তীব্র ধ্বনির মধ্যে। লাল-সবুজের প্রতিটি পয়েন্টে সেই আওয়াজ তুঙ্গে। ১৫-১৪, ২২-১৯ করে বাংলাদেশ এগিয়েই থাকল পুরো গেমে, শেষ ২৫-২২-এ জয়। লিগ পর্বেও কিরগিজস্তানের বিপক্ষে জয় দিয়েই শুরু করেছিল স্বাগতিকরা। এদিনও তা-ই হলো। সেই ম্যাচে দ্বিতীয় গেমে সমতায় ফেরে কিরগিজরা। এদিন সেই সুযোগ তারা পেলই না। দ্বিতীয় গেমেও একই রকম দাপুটে পারফরম্যান্স জাবিরদের। দর্শক বাড়তে বাড়তে ইনডোর তখন পূর্ণপ্রায়। স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী মোল্লা প্রতি খেলাতেই বিশাল বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন দিতেন, এদিনও নারী-পুরুষ মিলিয়ে শ-পাঁচেক সমর্থক ঢুকেছে তাঁর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর নামে এই আসর, তাদের উল্লাসের সঙ্গে জয় বাংলা ধ্বনিও কাঁপিয়ে দিচ্ছিল বিশাল ইনডোর। পাশেই শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এখন খেলা নিয়ে যত উন্মাদনা সেখানে। তবে ভলিবল খেলোয়াড়দের দারুণ পারফরম্যান্স টেনে এনেছে যেন সবাইকে। জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি গায়ে ড্রাম হাতে একদল তরুণ পুরো ম্যাচ যেভাবে উৎসাহ দিয়ে গেল জাবির-মাসুদদের, তা অভূতপূর্ব। বাংলাদেশ দল এ সমর্থনেই যেন উদ্দীপ্ত হচ্ছিল আরো। এদিন দ্বিতীয় গেমে কিরগিজদের তাই আর ফেরার সুযোগ হয় না, ১৪-১২, ২১-১৮ করে ২৫-২৩ এবারও জিতে যায় বাংলাদেশ। ইনডোরের উল্লাস তখন রীতিমতো গর্জনে রূপ নিয়েছে।
টানা দুই গেম জয় মানে তখন ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। স্বাগতিক তীব্র সমর্থনের মধ্যে ওদিকে কিছুতেই ছন্দ পাচ্ছে না কিরগিজ দল। অথচ শেষ গেমটা তাদের জীবন-মরণ। বাংলাদেশের সামনেও চ্যালেঞ্জ, দর্শকদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের যে ঢেউ তুলেছে তারা ম্যাচ জিতে তাতে যে জোয়ার বইয়ে দিতে হবে। প্রত্যাশার পারদ তখন এমনই উত্তুঙ্গে সোহেল, হরশিদ, মাসুদদের মাথা ঠাণ্ডা রাখাও কঠিন। সেই গেমেরই শুরুতে ৩-৬-এ পিছিয়ে পড়লে কোচ আলপোর আরোজি টাইম আউট নেন। বাংলাদেশ ম্যাচে ফেরে ৬-৬-এ। মাসুদ মিলন বাঁদিক থেকে একটানা কয়েকটি স্ম্যশে পয়েন্ট আদায় করে নেন। এই সময়েই আকস্মাৎ জয়ের দরজাটা খুলে যায়। কিরগিজদের এক খেলোয়াড় চোট পেয়ে চলে যান কোর্টের বাইরে। দলটির দুঃসাহস বলতে হয়—পুরো টুর্নামেন্ট খেলতে এসেছে তারা মাত্র ৯ জন খেলোয়াড় নিয়ে। দুজন আগেই ইনজুরড হয়েছেন, সপ্তমজনও যখন কাল ম্যাচের মধ্যেই বাইরে চলে গেলেন, তাদের আর খেলার উপায়ই থাকে না। কিরগিজ অধিনায়ককে মেনেই নিতে হয় সেটা, জয়ী ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশকে। যে মুহূর্তটির জন্য অধীর অপেক্ষায় পুরো ইনডোর, হঠাৎই সেই ঘোষণায় উচ্ছ্বাস হয় একেবারে বাঁধনহারা, খেলোয়াড়রাও যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেন। কিরগিজস্তান দলটিকে দেখে ইরানি কোচ আগেই বলেছিলেন, ‘এটি ঝুঁকিপূর্ণ হলো তাদের জন্য। ‘ শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো, ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষেই আত্মসমর্পণ করতে হলো তাদের। স্বাগতিকদের কৃতিত্ব ম্যাচটা তারা জয়ের পথেই ছিল। এই ম্যাচ বাংলাদেশ জিতলেই বরং অঘটন হতো। সেই সত্তরের দশক থেকে খেলোয়াড়, রেফারি, সংগঠক হিসেবে ভলিবলের সঙ্গে জড়িয়ে মনিরুল ইসলাম, তিনি অভিভূত এই নতুন বাংলাদেশ দেখে, ‘আমার ভলিবল জীবনে এর চেয়ে আনন্দের মুহূর্ত আর আসেনি। বাংলাদেশের ভলিবলে এই জয় এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।
রেকর্ড গড়ে ভলিবল চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ
Date:
Share post: