রুপালি ট্রফিটা সামনে ধরে অনেকের সঙ্গে বসে আছে এক কিশোর। গোপালগঞ্জের আন্তস্কুল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলের অধিনায়কও তিনি। সারা বিশ্ব যাঁকে রাজনীতিবিদ হিসেবেই চেনে, তিনি ছিলেন ওই সময় স্কুল দলের তুখোড় ফুটবলার। পরে ঢাকার মাঠে ওয়ান্ডারার্সের হয়েও খেলেছিলেন ১৯৪০ সালে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই অধ্যায়টা হয়তো অনেকেই তেমন জানেন না। বঙ্গবন্ধুর খেলোয়াড়ি জীবনের অন্যতম অর্জন সেই ট্রফিটার কোনো খোঁজই নাকি নেই শহরে!
১৯৩৬ সালে তৎকালীন মিশন স্কুল (বর্তমান সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ) মাঠে সীতানাথ একাডেমির হয়ে ফাইনাল খেলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। যে ম্যাচের রেফারি ছিলেন ডা. গোপাল কৃষ্ণ অধিকারী। গোপালগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শিবশঙ্কর অধিকারীর বাবা রেফারি গোপাল কৃষ্ণ। ওই ম্যাচের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কাল শিবশঙ্কর বলছিলেন, ‘ম্যাচের ফলটা আমার মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে বঙ্গবন্ধুর দল এসএন (সীতানাথ) একাডেমি জিতেছিল। বাবা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক গল্প করতেন। শহরে এলে আমাদের কলেজ রোডের বাড়িতেও আসতেন বঙ্গবন্ধু।’
এসএন একাডেমির দশম শ্রেণির ছাত্র বঙ্গবন্ধু খেলতেন আক্রমণভাগে। ওই ম্যাচের পর চ্যাম্পিয়ন দলের একটি ছবিও তোলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ: আলোকচিত্রের অ্যালবাম বইটিতে ছাপা হওয়া সেই ছবি দেখিয়ে বলছিলেন, ‘সামনের সারিতে বসা তৃতীয় জনই বঙ্গবন্ধু। পঞ্চম জন বঙ্গবন্ধুর অঙ্কের শিক্ষক মনোরঞ্জন অধিকারী। বঙ্গবন্ধুর পাশে গোলরক্ষক বতু মিয়া। পেছনে তৎকালীন এসডিও স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এসএন দাস।’
ফুটবলার বঙ্গবন্ধুকে তো পাওয়া গেল। কিন্তু তাঁর অধিনায়কত্বে জেতা সেই ট্রফিটা কোথায়? প্রশ্নটা করতেই মুখ শুকিয়ে পাংশুবর্ণ হয়ে যায় শিবশঙ্করের। দুঃখের সঙ্গে জানালেন, ‘এই ট্রফির কোনো হদিসই নেই। হয়তো বঙ্গবন্ধু কলেজে থাকতেও পারে।’ তাঁর কথার সূত্র ধরেই এই প্রতিবেদক গেলেন বঙ্গবন্ধু কলেজে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান উপাধ্যক্ষ জিতেন্দ্রনাথ বালা জানালেন, ‘১৯৭৭ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে এই ট্রফিসহ সবকিছু এলোমেলো হয়ে হারিয়ে যেতে পারে। আমরাও ওই ট্রফির কথা শুনেছি। এখনো ওটা খুঁজে চলেছি। শেষ পর্যন্ত না পেলে ওই আদলে আরেকটি রেপ্লিকা তৈরি করতে পারি আমরা।’
স্কুলজীবনের তুখোড় ফুটবলার এলাকাতেও নিয়মিত খেলতেন। শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক ভিটা টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে খোঁজ পাওয়া গেল তাঁর শৈশবের খেলার সাথিদের একজনকে। অশীতিপর মাজেদ শেখ গুছিয়েও কথা বলতে পারেন না। তবে বঙ্গবন্ধুর কথা তুলতেই আনন্দে চোখ চিকচিক করতে লাগল তাঁর। একে একে খুলে দিলেন মনের আগল, ‘আমরা ছিলাম সম্পর্কে পাড়াতো ভাই। একই সঙ্গে ফুটবল খেলেছি। উনি আমার চেয়ে বয়সে বেশ বড় ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কারও কোনো দিন ঝগড়া হয়নি খেলার মাঠে। আমাদের এলাকার খালের পাশে একটা হিজলগাছ ছিল। বর্ষাকালে একসঙ্গে ওই গাছে উঠে পানিতে ঝাঁপ দিতাম আমরা।’
মাজেদ শেখের স্মৃতি থেকে হয়তো একদিন এসব হারিয়ে যাবে। কিন্তু খেলোয়াড়ি জীবনের স্মরণীয় ওই ট্রফিটা থাকলে পরের প্রজন্ম নিশ্চয়ই অন্য বঙ্গবন্ধুকে চেনার সুযোগ পেত।
সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না বঙ্গবন্ধুর সেই চ্যাম্পিয়ন ট্রফির !
Date:
Share post: