বসত বিরোধপূর্ণ মুহুরির চরে কিন্তু ভোট দিলেন ত্রিপুরায়

Date:

Share post:

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরাতে রবিবার বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে – শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভোটদানের হার ছিল ৭৫ শতাংশের কাছাকাছি।

কয়েকটি জায়গায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়ে বিভ্রাট বাদ দিলে রাজ্যের ভোটপর্ব মিটেছে মোটামুটি শান্তিতেই।

আর এদিনই রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া বিলোনিয়াতে ভোট দিলেন এমন কয়েকশো মানুষ – যাদের বাস সীমান্তের বিতর্কিত মুহুরির চর ঘেঁষে, কিন্তু ভোট ভারতের মূল ভূখন্ডে।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই দাবি করে থাকে মুহুরির চরের অধিকাংশ এলাকা তাদের – আর সেই চরে গিয়ে দুদেশের মধ্যে ঐতিহাসিক স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন পর্যন্ত থমকে গেছে।বিলোনিয়া শহরে মুহুরি নদীর ওপরে সেতু

সীমান্ত বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু মুহুরির চর কীভাবে ত্রিপুরার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সামিল হল, সরেজমিনে সেটাই দেখতে গিয়েছিলাম ওই চরের বুকে।

দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার সদর বিলোনিয়া শহরকে ঘিরে যে মুহুরি নদী, বিএসএফের সতর্ক পাহারার মধ্যে দাঁড়িয়েছিলাম সেই নদীবাঁধের ওপরেই।

সামনে আদিগন্ত চরে সবুজ ফসল, মাঠে চরছে গরু-ছাগলের পাল। তবে একটু দূরেই দু-চারটে হলুদ পতাকাও নজর এড়াচ্ছে না, আর সেটাই না কি আপাতত ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে অস্থায়ী সীমানা-পিলার।

প্রায় ৬৭ একরের এই নদীচরে এসে দুদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তির রূপায়নও আটকে গেছে – তার কারণ এখানকার বিচিত্র জিওপলিটিক্স, ভূগোল আর কূটনীতি যেখানে জট পাকিয়ে গেছে।ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক সপ্তর্ষি মিত্র

ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: সপ্তর্ষি মিত্র বলছিলেন, “নদীর মাঝবরাবর একটা লাইন ধরে নেওয়া হয়েছে, যেটা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমানাকে চিহ্নিত করবে। এখন নদী একটা প্রাকৃতিক ভূমিরূপ, যার নিজস্ব মুভমেন্ট আছে। মুহুরি নদীর ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে, নদী মুভ করেছে।”

“এই যে মুহুরির চর জায়গাটা বলছেন, সেটা আসলে একটা ‘মিয়ান্ডার’ বা নদী-বাঁক। নদীবাঁকে জলবায়ু পরিবর্তন বা ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে নদীর গতিপথ বা বেগও পাল্টায়, আর সেই সঙ্গে ল্যান্ডস্কেপেরও পরিবর্তন হয়। ফলে নদীর চর তৈরি হয়, আর সেটা নদীর মাঝখানেও হতে পারে – আবার একধারেও হতে পারে।”

“এখন নদী যখন একদিক থেকে অন্যদিকে যায়, তখন স্বভাবতই চর তার উল্টোদিকে সরে। আর মূল সমস্যাটা ঠিক এখানেই, কারণ জমি একদিকে ভাঙছে, আর অন্যদিকে জমি তৈরি হচ্ছে!”, বলছিলেন অধ্যাপক মিত্র।বিলোনিয়া শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মুহুরি নদী

অর্থাৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল এই ল্যান্ডস্কেপের ওপর দিয়ে একটা কৃত্রিম সীমান্তরেখা টানার ফলেই যাবতীয় গন্ডগোলের সূত্রপাত।

আর গন্ডগোলের সেই চরের বুকেই রীতিমতো স্ত্রী-সন্তান, মা-ঠাকুমা আর একগাদা হাঁস-মুরগি, গরু ছাগল নিয়ে সংসার মহাদেব সাহার – যদিও রবিবার তিনি ভোট দিলেন শহরে গিয়ে।

মহাদেবের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। সে বলছিল, বিলোনিয়ার বর্ডারপাড়ায় ‘মুহুরির চর ল্যান্ডে’ তার ভিটেবাড়ি হলেও তাকে ভোট দিতে যেতে হবে শহরের ভেতরে গার্লস স্কুলে, যেটা প্রায় তিনশো মিটার ভেতরে।<মুহুরির চরের বুকে নিজের ভিটেমাটিতে দাঁড়িয়ে মহাদেব সাহা

কিন্তু কত লোক থাকেন এই মুহুরির চর আর বাঁধ-ঘেঁষা এলাকাটায়?

“ঠিকমতো বলতে পারি না, তবে এই বর্ডারপাড়ায় প্রায় দশ পনেরো হাজার লোকের বাস হবে। আর চরের বুকে আমি একাই আছি। কিন্তু আমিও চাই সরকার আমাকে তুইল্যা ভিতরে বসায় দিক, নইলে প্রতি বছরের ফ্লাডে ঘরবাড়ি পইড়্যা যায় গা!”

“ঘরে আমার একটা ঠাকুমা আসে একটা, অচল। তানের জায়গা। ঠাকুমা যতদিন ভাল ছিল সেও চেষ্টা করসে এখান থিকা যাওয়ার লিগ্যা। কিন্তু শহরের ভিতরি জমির কানি আশি-নব্বই লাখ কইর‍্যা, আমাদের দ্বারা তো কিনা সম্ভব না। ফলে এখানেই থাকতাসি কষ্ট কইরা – আর বিএসএফও এখানে ডিউটি দিতাসে, ফলে চুরিচামারি বড় একটা হয় না!”সন্তান

“হ আইসিল তো। ওই যে তালগাছটা দেখতাসেন, ওইখানে একটা প্ল্যাটফর্ম বানাইসে – সরকারি অফিসাররা বইসে। তারা চা-মিষ্টি খাইসে, তারপর যে কী কইসে হেইডা তো আর শুনসি না! হ্যারা তো সব সময়ই মিটিং করে … মিটিং কইর‍্যা, খাইয়া-দাইয়া কয় না, আর হইত না!” একটা করুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন মহাদেব সাহা।

মুহুরির চরের বিরোধ কেন আজও মেটানো গেল না, সেই আক্ষেপ চর ঘেঁষা ‘বর্ডারপাড়া’র আরও কয়েকশো বাসিন্দার।

প্রৌঢ় নারায়ণচন্দ্র মজুমদার যেমন বলছিলেন, “আমরা তো চাই নিষ্পত্তি হলেই ভাল হয়। চরটা এমনি খাইল্যা পইড়া রইসে, আমরা ভারতীয় জনগণ আগে চাষবাস করত – এখন কিন্তু আর চাষবাস হইতাসে না। এমনিতে সীমান্ত বিরোধ নিয়া বড় কোনও সমস্যা নাই, তবে চরটা নিয়া বিতর্ক রয়া গেসে – আমরা চাই মিটমাট হইয়া যাক।”মুহুরির চর ঘেঁষা বর্ডারপাড়ার বাসিন্দা নারায়ণচন্দ্র মজুমদার

এই চর এলাকার লোকজন ভারতের নির্বাচনে কীভাবে ভোট দিতে যাবেন, জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন, “ভোট তো আমাদের (ভারতের) ভিতরে। তবে ভোটটা তো যার যার ব্যক্তিগত অধিকার – এখন যার যে খুশি, তারেই ভোট দিবে আর কী!”

মুহুরির চর নিয়ে দীর্ঘদিন নানা স্টাডি করেছেন সোমপ্রকাশ ধর। তরুণ এই গবেষক বলছিলেন, বিলোনিয়াতে মুহুরি নদীর বাঁকটা ক্রমশ বড় হওয়াতেই চর এখন ভারতের দিকে বেশি সরে এসেছে – কিন্তু এই জমি অত্যন্ত উর্বর হওয়ায় কোনও পক্ষই সহজে এর দখল ছাড়তে রাজি নয়।

তার কথায়, “১৯৩৭ সাল নাগাদ ওখানে যে ল্যান্ড সেটেলমেন্ট সার্ভেটা হয়েছিল, তার পরবর্তী সময়ে কিন্তু দেখা গেছে মুহুরি নদীতে ডিপোজিশন বা সিল্টের পরিমাণ অনেক বাড়তে থাকে। এবং বাংলাদেশের দিকে চরের পরিমাণ কমে ভারতের দিকে সেটা বাড়তে থাকে – এবং নদীটা আস্তে আস্তে বাংলাদেশের দিকে ঘুরতে থাকে।”বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মুহুরিঘাট ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট

“এর ফলে আগে বাংলাদেশের দিকে চরের অংশটা কমে গিয়ে ভারতের দিকে একটা অস্থায়ী জমি তৈরি হয়। কিন্তু এই জমি খুবই উর্বর, কারণ পলিমাটি বা আমরা যাকে অ্যালুভিয়াল সয়েল বলি তার পরিমাণ এখানে খুব বেশি। আর সেই পরিমাণটা দিন প্রতিদিন এখানে বেড়েই চলেছে”, বলছিলেন সোমপ্রকাশ ধর।

এই অত্যন্ত উর্বর ভূখন্ডে এখন অবশ্য মহাদেব সাহার মতো হাতেগানা কয়েকজন ছাড়া কেউই চাষাবাদ করতে পারছেন না। মুহুরির চরে সীমানা বিরোধের নিষ্পত্তি না-হওয়ায় সেখানে নেই কোনও কাঁটাতারের বেড়াও।

কিন্তু যতক্ষণ না দিল্লি আর ঢাকার মধ্যে এই সীমানা জটের মীমাংসা হচ্ছে, ততক্ষণ বর্ডারপাড়ার এই কয়েকশো মানুষের সামনে একটা অদৃশ্য বাধার দেওয়াল যেন থেকেই যাচ্ছে – যে দেওয়াল পেরিয়ে তারা ভারতের নির্বাচনে রবিবার ভোট দিলেন, এবং দিয়ে আসছেন গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আবারো এস আলমে আগুন 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় এস আলম গ্রুপের চিনির গুদামের পর এবার তেলের মিলে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের...

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...