ঢাকায় মহররমের তাজিয়া মিছিল কি একটু বিবর্ণ?

Date:

Share post:

নিজের বুকে সজোরে চাপর মারতে মারতে আর ‘ইয়া হোসেন ইয়া হোসেন’ শ্লোগান দিতে দিতে সরু গলিটি ধরে এ়ে যাচ্ছিল একদল যুবক।

তাদের খালি পা। পরনে কালো শাক।

তারা একটি বিরাট মিছিলের অংশ। ঢাকার পুরনো অংশের হোসেনি দালান থেকে শুরু হয়েছে মিছিলটি। সরু গলি ধরে এগিয়ে যাচ্ছে মূল সড়কের দিকে।

এটি মহররমের ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল।

মিছিলে অংশ নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। নারী-পুরুষ-শিশু। বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য এরা।

অনেকের হাতে বিশাল দণ্ড, তার মাথায় ব্যানার কিংবা পতাকা। মিছিলে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের কাছে এটির নাম ‘আলম’।

গলির দুধারে দাঁড়িয়ে মিছিলটির এগিয়ে যাওয়া দেখছে আরো হাজার হাজার মানুষ। এদের বেশীরভাগই বোরকা পরিহিত নারী। তারাও বুকে চাপর দিচ্ছেন আর ‘ইয়া হোসেন’ শ্লোগানের সাথে সুর মেলাচ্ছেন।

মিছিলের পেছনে ‘দুলদুল’ নামে যে সুসজ্জিত ঘোড়াটিকে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছিল সেটির পায়ের পর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন এই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকে।মেটাল ডিটেক্টর পার হয়ে সবাইকে প্রবেশ করতে হয় হোসেনি দালান।

কেউ ঘোড়াটির পদচুম্বন করছিলেন। কেউবা হাতের বোতল থেকে দুধ ঢেলে ধুইয়ে দিচ্ছিলেন ঘোড়াটির পা।

দীর্ঘ মিছিলটি শেষই হচ্ছে না। দুপাশের বাড়িগুলোর ছাদও ভরে গেছে।

দু’বছর আগে ২০১৫ সালে এই হোসেনি দালানের সামনেই তাজিয়া মিছিল শুরু হওয়ার প্রাক্কালে একটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

ওই হামলায় একজন নি হয়, আহত হয় শতাধিক।

তারপরের বছর, গতবছর এই তাজিয়া মিছিল অনুষ্ঠিত হয় কঠোর নিরাপত্তা স্থার মধ্যে দিয়ে। এবছর পুলিশি নিরাপত্তা আরো বেশী।

সকাল থেকেই হোসেনি দালানের প্রবেশের সবগুলো রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।

সড়কগুলোতে অব নিয়েছে শত শত পুলিশের সদস্য, র‍্যাব, বোমা স্কোয়াডের সদস্যরা। রাস্তার পাশে রাখা হয়েছে কামান। মিছিলের পুরো রুট জুড়েই রাস্তার দুধারে রয়েছে তাদের উপস্থিতি।

হোসেনি দালানে প্রবেশের মুখে বসানো হয়েছে মেটাল ডিটেক্টর। সেখান থেকে যারা প্রবেশ করছে তাদের পড়তে হচ্ছে কঠোর তল্লাশির মুখে। ঢুকতে হচ্ছে সারিবদ্ধ ভাবে।

এই তল্লাশি পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেছেন মোহাম্মদ নওয়াব মিয়া। তিনি বলছেন, “এই তল্লাশি নিয়ে আমাদের কোন আপত্তি নেই। এটা সবার নিরাপত্তার জন্য করা হয়েছে। ওনারা যে খেদমত করতেছেন আমাদের তাতে আমার সবাই খুশী আছি।”সুসজ্জিত এই ঘোড়াটিকে বলা হয় ‘দুলদুল’।

কোনরকম আতঙ্ক কি আছে? জান্নাতুল ফেরদাউস নামের এক তরুণী বলছেন, “বোমা হামলা করেছে, তারপরও আমরা মিছিল বন্ধ রাখিনি, চালিয়ে গিয়েছি। হাঁটু পর্যন্ত পানি হয়েছে তারপরও চালিয়ে গেছি”।

“আমাদের কোন ভয়ভীতি নেই। আল্লাহর পথে যাব, আল্লাহ আমাদের জীবন দেবে”।

তাজিয়া মিছিলে ফিরে দেখা যায়, অনেকেই ‘আলম’ বহন করছেন, কিন্তু একটি একটি আলমের দৈর্ঘ্য ১২ ফুটের বেশী হতে পারবে না, সেটা পুলিশ আগেই বলে দিয়েছে।

েট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর বলছেন, নিরাপত্তার খাতিরেই এবার তাজিয়া মিছিলকে কেন্দ্র করে অনেক গুনগত পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার মধ্যে এই আলমের দৈর্ঘ্য বেঁধে দেয়াটাও একটা। এর আগে এক একটি আলমের দৈর্ঘ্য হতো ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত।

এছাড়া কোন ধারালো অস্ত্রও বহন করা যাবে না, ফলে তাজিয়া মিছিলের অন্যতম একটি ঐতিহ্য যেখানে শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীরা মাতম করার সময় ধারাল অস্ত্র দিয়ে নিজেদের শরীর রক্তাক্ত করতো, সেটাও এবার দেখা যাবে না।

এতে কি তাজিয়া মিছিল কিছুটা বিবর্ণ হবে?

হোসাইনি দালানের মুখপাত্র সৈয়দ বাকের রেজা মজলুম বলছেন, “কিছুটা বিঘ্নতো ঘটবেই। আমাদের যারা জিনজির মাতম করত (ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজের শরীর রক্তাক্ত করা) ওরা হয়তো মণক্ষুন্ন হবে। কিন্তু এটাতো বিশেষ প্রয়োজন কিংবা আমাদের না হলে চলবে না, এমন নয়। আমরা সাময়িক ভাবে বন্ধ করেছি। আগামীতে পরিস্থিতি ঠিক হলে আবার আরম্ভ হবে”।

কিন্তু গত দুবছর তাজিয়া মিছিলে অংশ নেয়া মানুষের সংখ্যা ব্যাপক কমে যেতে দেখেছেন এই হোসাইনি দালানের আশপাশের বাসিন্দারা।

তাজিয়া মিছিল দেখবার জন্য বাড়িগুলোর ছাদ ভরে উঠেছে নারী-পুরুষ-শিশুতে।

একটি ছাদে উঠে কথা হয় এক গৃহবধূর সাথে। তিনি বলছেন, “আমরা ছাদে দেখতাম না। নিচে সবাই থাকতাম। ঘোড়ার পা ধোয়াইতাম। এখনতো আমরা একটা আতঙ্কের ভেতর থাকি”, বলছিলেন তিনি। বাসার ছাদ থেকে অনেকে দেখন তাজিয়া মিছিল।

আরেক বৃদ্ধা বলছিলেন, ২০১৫ সালের ওই বোমা হামলায় তাদের বাড়ির এক আত্মীয় আহত হয়েছিলেন। তারা বাড়ির কোন ছেলেমেয়েকেই এখন আর তাজিয়া মিছিলের দিন ঘরের বাইরে বের হতে দেন না। সবাই ছাদে দেখেন।

“শত্রুরা আছে, যদি একটা বোম-টোম মাইরা দেয়.. ভয়ইতো…ভয়ের জন্যিই আর যাইনা”, বলছিলেন এই বৃদ্ধা।

আগে মহররমের দিন হোসাইনি দালানের আশপাশে রীতিমত মেলা বসে যেত, এখন আর কোন দোকানপাটই বসতে দেয়া হয়না, বলছিলেন আরেকজন।

তাজিয়া মিছিলটিতেও সামনে-পেছনে-ডানে-বামে যে পরিমাণ পুলিশ আছে তার ঘেরাটোপে থাকা শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে শোরগোল ছিল কম, ভাবগাম্ভীর্য আর সতর্কতা ছিল বেশী।

নিজের শিশুকন্যাকে নিয়ে মিছিল দেখতে এসেছেন য়ী মোহাম্মদ কাদের। তিনি প্রতিবছরই এই সরু গলিতে দাঁড়িয়ে তাজিয়া মিছিলের চলে যাওয়া দেখেন। তার চোখে তাজিয়া মিছিলের রং আজকাল কিছুটা বিবর্ণ।

“আগে যেভাবে মিছিলটা হতো সেরকম নাই আর এখন। আগে প্রচুর লোকজন হতো। লোক একটু কমে গেছে এখন”। বলছিলেন মি. কাদের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে : প্রধান উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরে আমাদের আয়োজন ছিল সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে...

শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে সচিবালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের পদত্যাগের...

২৪ তারিখের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত

আগামী ২৪ জুলাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার। মঙ্গলবার (২২...

২০ শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা শিক্ষিকা মেহেরীন শহীদ জিয়াউর রহমানের ভাতিজি

রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিজের জীবন তুচ্ছ করে ২০ শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে...