রাশিয়ায় পরমাণু বোমা ফেলা নিয়ে রেগানের ঠাট্টায় ব্যাপক তোলাপাড়

Date:

Share post:

১৯৮৪সালের অগাস্ট মাসে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের হালকা একটা মশকরা রাশিয়ায় সম্ভাব্য পারমাণবিক হামলা একটা উদ্বেগের ঢেউ তুলেছিল।

কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই পরিস্থিতি?

তারিখটা ছিল ১৯৮৪ সালের ১১ই অগাস্ট। জাতির উদ্দেশ্যে তার সাপ্তাহিক ভাষণ দেবার আগে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান মাইক্রোফোন পরীক্ষা করে নিচ্ছিলেন।

পরীক্ষার সময় মাইক্রোফোনে তিনি বলেন: “প্রিয় দেশবাসী -আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি আমি একটা আইন সই করেছি যাতে রাশিয়া চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ দেশ হয়ে যাবে। আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখানে বোমাবর্ষণ শুরু করতে যাচ্ছি।”

প্রেসিডেন্ট রেগানের এই কথাগুলো অবশ্যই ওই সাপ্তাহিক ভাষণের অংশ ছিল না, কিন্তু তার কথাগুলো রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল এবং দ্রুত তা বাইরে ফাঁস হয়ে যায়।

একসময়ে প্রেসিডেন্ট রেগানের উপদেষ্টা মর্টন ব্ল্যাকওয়েল বিবিসিকে বলেছেন প্রেসিডেন্ট স্বভাবতই ঠাট্টা করে ওকথা বলেছিলেন।

“সবাই জানত তিনি একজন সজ্জন ব্যক্তি। উনি ঠাট্টা করছিলেন- উনি কখনই প্রচারের জন্য ওকথা বলেননি- ওনার ওই মস্করায় সকলেই কিন্তু মজা পেয়েছিল।”

মর্টন ব্ল্যাকওয়েলের যদিও মনে হয়েছিল মিঃ রেগানের ওই মন্তব্য ছিল বেশ মজার, কিন্তু পশ্চিমের বহু ভাষ্যকারের মনে হয়েছিল তার এই ঠাট্টা ছিল বেশ খারাপ রুচির পরিচয়। আর মস্কোতে এই মন্তব্যে ঝড় উঠেছিল।

সোভিয়েত সংবাদ সংস্থা তাসের খবরে বলা হয়েছিল : “তাসকে একথা জানানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিবৃতিতে যে নজিরবিহীন বৈরিতা প্রকাশ পেয়েছে তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষুব্ধ। একজন রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য এটা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয়। বিশেষ করে একটা পরমাণু শক্তিধর দেশের জন্য।” প্রেসিডেন্ট রেগান তার নানা ভাষণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।

রাশিয়ায় পরমাণু বোমা ফেলা হবে- রেগানের এই মশকরা কীভাবে তোলাপাড় তুলেছিল?

রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা তখন একের পর এক যেসব হুমকি দিচ্ছিল, প্রেসিডেন্ট রেগানের এই মশকরাকে রাশিয়া দেখেছিল তারই অংশ হিসাবে।

দুবছর আগেই মিঃ রেগান অঙ্গীকার করেছিলেন কম্যুনিজমকে তিনি ইতিহাসের আবর্জনাস্তুপে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন- কথাটা তিনি ধার করেছিলেন লিওন ট্রটস্কির কাছ থেকে। এরপর মি: রেগান সোভিয়েত ইউনিয়নকে এভিল এম্পায়ার- অশুভ সাম্রাজ্য বলে আখ্যা দেন।

মর্টন ব্ল্যাকওয়েল তখন গণযোগাযোগ বিষয়ে প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী ছিলেন।

জাতীয় পর্যায়ে ধর্ম বিষয়ক সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর এক সম্মেলনে যখন প্রেসিডেন্ট রেগান ভাষণ দেন, তখন মি: ব্ল্যাকওয়েলের পরামর্শে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সেখানে প্রথম একটা অশুভ সাম্রাজ্য বলে বর্ণনা করেন।

“সেটা একেবারে সঠিক ছিল- শতকরা ১০০ ভাগ সঠিক বর্ণনা ছিল। কিন্তু পশ্চিমের প্রায় কেউই তখন এই সত্যটা প্রকাশ করতে নারাজ ছিল।”

মর্টন ব্ল্যাকওয়েলের মত মার্কিন রক্ষণশীলদের কাছে কম্যুনিজম ছিল মানবতার চরম শত্রু।

“আমি যখন বড় হচ্ছি তখন দুএক বছর অন্তর অন্তর পৃথিবীর নতুন মানচিত্র প্রকাশ হত। তাতে কম্যুনিস্ট ভাবধারায় প্রভাবিত দেশগুলোকে লাল রঙে দেখানো হতো। আর বছর বছর দেখতাম আরও নতুন নতুন দেশ কম্যুনিস্ট হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা খুবই গুরুতর ছিল।”

মর্টন ব্ল্যাকওয়েল বলছেন সারা বিশ্বে কম্যুনিস্ট ভাবধারার বিস্তার ঘটাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। “কিন্তু সত্যি বলতে কী, পশ্চিমে খুব কম লোকেরই ধারণা ছিল সেটা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে।”

কাজেই কম্যুনিজমকে গুঁড়িয়ে দেবার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট রেগানের প্রতিশ্রুতি আমেরিকার রক্ষণশীলরা খুবই পছন্দ করতেন।

এর উপর সাবেক চিত্রতারকা মি: রেগান কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে তার জেহাদে মাঝেমধ্যেই খানিক হালকা সুর যোগ করার চেষ্টা করতেন। তিনি সোভিয়েতদের নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করতে ভালবাসতেন।

মর্টন ব্ল্যাকওয়েল তাকে এধরনের মস্করার উপকরণ যোগাতেন। ইসরায়েলে সোভিয়েত শরণার্থীদের কাছ থেকে তিনি এধরনের নানা উপকরণ সংগ্রহ করতেন আর ইংরেজিতে অনুবাদ করে তা মি: রেগানের হাতে তুলে দিতেন।

“আমি এগুলো প্রিন্ট করে প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠাতাম। তিনি উত্তরে আমাকে চিঠিতে ধন্যবাদ জানাতেন। বলতেন এই সরস মন্তব্যগুলোর মধ্যে কিন্তু অনেক খাঁটি কথা আছে। আমার দেওয়া এধরনের নানা কথা তিনি পরে বিভিন্ন ভাষণে ব্যবহার করছেন। এসব তথ্যসম্বলিত চুটকি বইটা ওনার ভাষণলেখকের দারুণ পছন্দের ছিল। তিনি ওখান থেকে দরকারমত নানা কথা প্রেসিডেন্টের ভাষণে ঢুকিয়ে দিতেন।”মর্টন ব্ল্যাকওয়েলের মত মার্কিন রক্ষণশীলদের কাছে কম্যুনিজম ছিল মানবতার চরম শত্রু। (ডানে- মর্টন ব্ল্যাকওয়েল)

তবে বেশিরভাগ মানুষের কাছেই শীতল যুদ্ধ কোনো ঠাট্টাতামাশার বিষয় ছিল না। রেগানের প্রথম মেয়াদে আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। দুই পরাশক্তির মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে তিক্ত অভিযোগ -পাল্টা অভিযোগ ক্রমশ বাড়তে থাকে।

সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নে জনগণকে প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতো আমেরিকাই বিশ্বের একমাত্র দেশ যে হিরোশিমা আর নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলেছে। সোভিয়েত শিশুদের মনে সবসময় একটা ভয় কাজ করত – আমেরিকা যদি তাদের ওপর পারমাণবিক হামলা চালায়! স্কুলে তাদের শেখানো হতো এধরনের বিপর্যয় ঘটলে কী করতে হবে।

এ সময় প্রেসিডেন্ট রেগানের পারমাণবিক হামলা নিয়ে মশকরা করা ওই মন্তব্য সোভিয়েত গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় এবং সেখানে আমেরিকা বিরোধী একটা উন্মাদনা তৈরি হয়।

১৫ই অগাস্ট ১৯৮৪- ইজভেস্তিয়ায় লেখা হয়: “এটাকে নিছক কুরুচিকর রসিকতা বললে কম বলা হবে। এটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শের একটা নগ্ন রূপ – যেটা খুবই সামরিক মেজাজে আর দায়িত্বহীনভাবে প্রকাশ পেয়েছে। রেগানের স্বপ্ন হল রাশিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা। গত চার বছর ধরে একনাগাড়ে রেগান অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ইন্ধন জোগাতে বিশাল প্রতিরক্ষা বাজেটে সই করে যাচ্ছেন। শান্তিপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে সুপরিকল্পিতভাবে এবং অন্যায়ভাবে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এই শান্তি উদ্যোগ বিশ্বকে ভয়াবহ পারমাণবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারত।”

মি: রেগানের ওই ঠাট্টা মস্কোয় গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল।

কিন্তু মর্টন ব্ল্যাকওয়েলের মতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ তাদের নিজস্ব জগতে বাস করত। আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল বলেই তারা ওই মন্তব্যকে সিরিয়াসলি নিয়ে ভয় পেয়েছিল।মিখাইল গরবাচফের সংস্কার প্রক্রিয়ার জেরে পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নে কম্যুনিজমের পতন ঘটে।

“রেগান তার ভাষণে বোমা ফেলার কথা কখনই বলেন নি। তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঠাট্টা করে কথাটা বলেছিলেন। তবে এটা আমি মানি যে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাসিন্দাদের পক্ষে পশ্চিমের এসব নিয়ে ঠাট্টা-মস্কর করার প্রবণতাটা বোঝা কঠিন ব্যাপার ছিল। তারা যদি বুঝতে পারত কথাটা শুধু হালকা চালে মজা করে বলা হয়েছে, তাহলে তারা এতটা ভয় পেত না,” বলেছেন মি: ব্ল্যাকওয়েল।

আসলে সোভিয়েত নাগরিকদের বেশিরভাগেরই ওয়াশিংটনের হাবভাব সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না- কোনটা নিয়ে তারা মজা করছে – কোনটা সিরিয়াসলি বলছে সেটা বোঝা আসলেই তাদের জন্য কঠিন ছিল।

তাছাড়া সোভিয়েত নেতৃত্বের ওপরেও দেশের মানুষ সেসময় তেমন ভরসা করতে পারছিলেন না। সেসময় তিন বছরে তিনজন সোভিয়েত নেতা মারা গেছেন। প্রেসিডেন্ট রেগানকে ঠাট্ট করে বলতে শোনা যেত “জানি না মস্কোর কোন্ নেতা এখন বেঁচে আছেন?- কার সঙ্গে আলোচনা করব? “

১৯৮৫র গোড়ার দিকে যখন ক্ষমতায় আসেন মিখাইল গরবাচফ, তখন দেশের মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কারণ তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত কমবয়সী, সুস্থ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে সংস্কার আনতে ও পশ্চিমের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। তার সংস্কার প্রক্রিয়ার জেরে পরবর্তীকালে কম্যুনিজমের পতন ঘটে।

তবে মর্টন ব্ল্যাকওয়েলের বিশ্বাস এর জন্য কৃতিত্ব প্রাপ্য রোনাল্ড রেগানেরই।

“তিনি বেশ কিছু পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন যার ফলে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এবং আমি যে এসময় তার সঙ্গে ছিলাম তার জন্য আমি খুবই গর্বিত। আমি মি: রেগানের সঙ্গে কাজ করেছি দীর্ঘদিন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম আমেরিকার জন্য রোনাল্ড রেগানই যথার্থ নেতা। পরে এটাও প্রমাণিত হয়েছে বিশ্ব রাজনীতির জন্যও তিনি কত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।”

রোনাল্ড রেগান মারা যান ২০০৪ সালে।

ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্ব পরিবেশন করেছেন মানসী বড়ুয়া।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আবারো এস আলমে আগুন 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় এস আলম গ্রুপের চিনির গুদামের পর এবার তেলের মিলে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের...

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...