যুক্তরাষ্ট্র যে ধুয়া তুলে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করছে, তা এককথায় ভিত্তিহীন। বাণিজ্যঘাটতি থাকা মানেই খারাপ কিছু নয়। এ ছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যে বাণিজ্যঘাটতির কথা বলে, তার মধ্যে শুভংকরের ফাঁকি আছে। ঘাটতির যে হিসাব দেওয়া হয়, তা মূলত পণ্য–বাণিজ্যের। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে ঠিক, কিন্তু একই সঙ্গে যে যুক্তরাষ্ট্রের সেবা–বাণিজ্যে বড় ধরনের উদ্বৃত্ত আছে, সেটা তারা বলে না, বা সুবিধা নেওয়ার জন্য এড়িয়ে যায়। ফলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ঠিক কী কারণে যুক্তরাষ্ট্র এ বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছে।
সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আচরণ করেছেন, সেই ঘটনা থেকে বাণিজ্যযুদ্ধের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে আঁচ করা যায়। সেটা হলো, উদীয়মান কোনো দেশকে আটকে দেওয়া। একসময় জাপানের বিরুদ্ধে একই অবস্থান নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। মুদ্রা কারসাজি থেকে শুরু করে নানাভাবে জাপানের উত্থান তারা ঠেকিয়ে দিয়েছে। এরপর বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি হিসেবে চীনের উত্থান ঠেকাতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। এত দিন চীনকে ঠেকানোর কৌশলের অংশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে খাতির রাখলেও শুল্ক ও ভূরাজনৈতিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত কদর্যভাবে ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই ভূ–অর্থনীতির প্রভাব ভূরাজনীতিতেও পড়বে।
ট্রাম্পের শুল্কসংক্রান্ত বয়ানের না–বলা সত্যটি হলো, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেবা–বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত ২৯৩ বিলিয়ন বা ২৯ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় এই উদ্বৃত্ত বেড়েছে ৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালের তুলনায় বেড়েছে ২৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এ তথ্য দিয়েছে সিএনএন।
এ ছাড়া যেকোনো দেশ উন্নতির বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন খাতের ওপর নির্ভর করে, যেমন প্রথমে কৃষিনির্ভরতা, তারপর শিল্পনির্ভরতা। এরপর যখন সেই দেশ উন্নতির চরম শিখরে উঠে যায়, তখন সেবা বা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রও সেই কালপর্ব পেরিয়ে এসেছে। পৃথিবীতে আজ যত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, তার প্রায় সবই তাদের তৈরি। এখন চীন সেই পথ ধরছে। ভারত কিছু আগেই সেবা বা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে বলে অনেক অর্থনীতিবিদ অভিযোগ করেন। উৎপাদন খাতে বিকশিত হওয়ার আগেই তারা সেবা খাতের দিকে এগিয়েছে। ফলে ট্রাম্প চাইলেই এখন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনের দিকে নিতে পারবেন না।
বিষয়টি হলো, শুল্ক নিয়ে চাপ দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো কৌশল বা অস্ত্র। ১৯৩০–এর দশকে এভাবেই চাপে ফেলেছিল জাপানকে। অন্যান্য কারণের সঙ্গে যুক্ত হয় বাড়তি শুল্ক। এর মধ্য দিয়ে জাপানকে জার্মানির পক্ষ নিতে বাধ্য করা হয়। এবারও বাড়তি শুল্কের কারণে জাপানে সরকার বিপদে পড়ে যাচ্ছিল। অবশেষে শুল্ক কমাতে জাপান অসম বিনিয়োগ প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় জাপান ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ায়। ষাট ও সত্তরের দশকে তারা শিল্প, প্রযুক্তি ও রপ্তানি খাতে অবিশ্বাস্য সাফল্য পায়, বিশেষত গাড়ি, ইলেকট্রনিকস আর সেমিকন্ডাক্টরে। কিন্তু আশির দশকে এসে চিত্রটা বদলে যায়। জাপানের তৈরি টয়োটা, হোন্ডা কিংবা সনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছিল না, বরং তাদের দাপটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি বিপজ্জনক মাত্রায় চলে যাচ্ছিল। ওয়াশিংটনের কাছে এটি ছিল একধরনের ‘অর্থনৈতিক হুমকি’।
১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র এক ঐতিহাসিক চুক্তির উদ্যোগ নেয়—প্লাজা অ্যাকর্ড। এতে জাপানসহ পাঁচটি বড় অর্থনীতির দেশ মার্কিন ডলারের মান কমাতে আর ইয়েনের মান বাড়াতে সম্মত হয়। মুহূর্তের মধ্যে জাপানি মুদ্রা শক্তিশালী হয়ে যায়। ফলে তাদের রপ্তানি পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎই দামি হয়ে পড়ে, প্রতিযোগিতা–সুবিধা হারাতে শুরু করে জাপানি শিল্প। এই ধাক্কা সামলাতে জাপান অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও শেয়ারবাজারে বিপুল অর্থ ঢেলে দেয়, যে কারণে পরবর্তীকালে ভয়াবহ জল্পনা-কল্পনার বুদ্বুদ তৈরি হয়।
১৯৯৫ সালে জাপানের মানুষের মাথাপিছু জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ৫৪ শতাংশ বেশি ছিল। এখন তা এতখানি উল্টে গেছে যে কারও চোখ কপালে উঠতে পারে—২০২৩ সালে মার্কিনদের মাথাপিছু জিডিপি জাপানিদের তুলনায় ছিল ১৪৫ শতাংশ বেশি। বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্র অঙ্গরাজ্য মিসিসিপির মাথাপিছু জিডিপি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জাপানের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ ঘাটতি নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র খারাপ ছিল না।
বাণিজ্যের ন্যায্য নীতি কী বস্তু? স্বাভাবিকভাবে যে বাণিজ্যে ভর্তুকি ও বাধা থাকবে না, সেটাই ন্যায্য বাণিজ্য। তবে নিশ্চিতভাবেই আমাদের পৃথিবী এ রকম বাণিজ্যের আশপাশেও নেই। উদারীকরণের এই অসমতার কারণে এক গোষ্ঠীর বিনিময়ে আরেক গোষ্ঠী লাভবান হয়। উন্নত দেশগুলো কৃষিকে সুরক্ষিত রাখতে ভর্তুকি দেয়, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন কৃষিতে ভর্তুকি দিতে না পারে, সে জন্য নানা ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা তৈরি করে। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, তার মূলে আছে এই কৃষি খাতের বাজার উন্মুক্ত করা নিয়ে বিরোধ। যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের বিশাল কৃষিবাজারে ঢুকতে চায়, কিন্তু ভারত নিজেদের কৃষকদের সুরক্ষা দিতে বদ্ধপরিকর। তারা এই বাজার ছাড়বে না। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ভারতকে নিজের সমতুল্য মনে করছে, যদিও দুই দেশের মধ্যে যোজন যোজন ব্যবধান। নোবেল বিজয়ী জোসেফ স্টিগলিৎসের মতো অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশকে আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে।
যাহোক, দীর্ঘ আট দশক ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রই ছিল মুক্তবাণিজ্যের ধারক ও বাহক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের যুগে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার আওতায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (জিএএটি ও পরবর্তী ডব্লিউটিও), বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে শিখিয়েছে, ‘বাণিজ্য উন্মুক্ত করো, শুল্ক কমাও, প্রতিযোগিতা বাড়াও’। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই ইতিহাসে নাটকীয় মোড় পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি একের পর এক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন, বাতিল করেন, আবার আলোচনায় বসেন বা তাতে কঠোর শর্ত জুড়ে দেন। এর পেছনে আছে তাঁর তথাকথিত ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। এর মূল দর্শন হলো, ‘যা আমেরিকার জন্য ভালো নয়, তা আমরা মানব না।’ বাণিজ্যচুক্তির শর্ত হিসেবে তিনি চেষ্টা করছেন, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সর্বোচ্চ রক্ষা করা যায়; দেশগুলোকে বাধ্য করছেন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য কিনতে। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে মুক্তবাণিজ্যের মূল শর্তই ক্ষুণ্ন করছেন ট্রাম্প। বিশ্বায়নব্যবস্থা ছুড়ে ফেলছেন। অর্থাৎ যত দিন বিশ্বায়ন যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করেছে, তত দিন তারা এর পক্ষে সাফাই গেয়েছে, এর সপক্ষে নানা বয়ান তৈরি করেছে।
মোদ্দাকথা, পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পতনশীল। চীন উঠে আসছে। সেই সঙ্গে আছে ভারতসহ ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো। অতীতে দেখা যেত, যে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে শীর্ষস্থানে চলে যায়, বিশ্বরাজনীতিসহ কূটনীতিতে তাদের আধিপত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়। একসময় যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে ইউরোপীয়রা বিশ্বব্যবস্থায় কর্তৃত্ব করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনরা সেই জায়গায় দখল করে। কিন্তু এখন যখন চীনের মতো দেশ উঠে আসছে, বিশ্বব্যবস্থায় তাদের যথাযথ স্থান দেওয়া হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগ বিশ্বব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ও টেকসই উন্নয়নের পুরোধা ব্যক্তিত্ব জেফরি ডি স্যাক্স মনে করেন, এ সবকিছুর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পতন ত্বরান্বিত হবে। মার্কিন সাংবাদিক গ্লেন ডিজেনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পৃথিবী যেমন বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে, ঠিক তেমনি একাধিক মুদ্রাকেন্দ্রিক ব্যবস্থার দিকেও এগোচ্ছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ডলারের শক্তি আরও কমবে। এবার ট্রাম্পের এই শুল্কযুদ্ধের কারণে পরিস্থিতির আরও দ্রুত অবনতি হবে বলেই তিনি মনে করেন। কেননা মার্কিন অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে ট্রাম্প একধরনের ভ্রমের মধ্যে আছেন বলে মনে করেন জেফরি ডি স্যাক্স। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনের মৌলিক বোঝাপড়ায়ও ঘাটতি আছে বলে তাঁর মত। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে উনিশ শতকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিশ্বায়ন ব্যবস্থায় সমস্যা আছে ঠিক। এই ব্যবস্থা এত দিন ধনী দেশগুলোর স্বার্থেই গেছে। এখন যখন চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো উঠে আসছে, তখন খোদ যুক্তরাষ্ট্র সেই ব্যবস্থার রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করছে। বিশ্বায়ন নিজে কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা যেভাবে উপস্থাপনা করা হচ্ছে, তাতে মনে হয়, সেটাই সমস্যা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, এ অব্যবস্থাপনা দূর হচ্ছে না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বায়নের অসন্তোষ কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যবস্থাকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, যেখানে ফেরত যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সম্ভবত তাঁর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে অন্যান্য দেশের উত্থান যতটা সম্ভব ঠেকানো যায়, তা নিশ্চিত করা।