তিব্বতি বৌদ্ধদের নেতা চতুর্দশ দালাই লামা বলেছেন, তিনি পুনর্জন্ম নেবেন এবং তার স্থাপিত অলাভজনক সংস্থারই কেবল তার উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার এখতিয়ার থাকবে।
নতুন দালাই লামা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের হস্তক্ষেপের আশঙ্কাকে ফের অগ্রাহ্য করে তিনি বুধবার এসব জানিয়েছেন।
তার মৃত্যুর পর নতুন দালাই লামা আসবে কিনা, তা নিয়ে কোটি কোটি ভক্ত-অনুসারীর কৌতুহল ছিল। রোববার ৯০ বছরে পা দিতে যাওয়া দালাই লামার সর্বশেষ এ মন্তব্যে সে কৌতুহল দূর হল, বলছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী চতুর্দশ দালাই লামা পঞ্চদশ তিব্বতিয়ান ধর্মীয় সম্মেলনে কী বক্তব্য দেন, তাতে উত্তরসূরি নিয়ে কী দিকনির্দেশনা থাকে সেদিকে ভারত, চীন এমনকি কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রেরও ব্যাপক আগ্রহ ছিল।
বুধবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বেইজিংয়ের আগের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, দালাই লামার উত্তরসূরি নির্ধারণে চীনের অনুমোদন অপরিহার্য, এবং শতাব্দীপ্রাচীন আচার অনুসারে এই উত্তরসূরি নির্বাচন চীনের ভেতরেই হতে হবে।
চীনের কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে হওয়া ব্যর্থ এক বিদ্রোহের পর ১৯৫৯ সালে দেশটি থেকে পালিয়ে যাওয়া এই চতুর্দশ দালাই লামাকে বেইজিং বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখে।
তিব্বতিদের এ নেতা এর আগে বলেছিলেন, তার উত্তরসূরি চীনের বাইরে জন্ম নেবে। বেইজিং কাউকে উত্তরসূরি মনোনীত করলে তাকে প্রত্যাখ্যান করতে ভক্তদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিলেন। তবে কয়েক বছর আগে তিনি একবার বলেছিলেন, এমন হতে পারে যে, তার কোনো উত্তরসূরি নাও থাকতে পারে।
“আমি নিশ্চিত করছি যে, দালাই লামা প্রথা অব্যাহত থাকবে,” ভারতের উত্তরাঞ্চলে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত শহর ধর্মশালায় আয়োজিত সমাবেশে দেওয়া ভিডিও বক্তৃতায় বুধবার এমনটাই বলতে শোনা যায় বর্তমান দালাই লামাকে।
এই সমাবেশে হাজির হয়েছেন শতাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষু, তাদের পরনে দেখা গেছে মেরুন রঙয়ের আলখাল্লা। আরও আছেন বিশ্বের বিভিন্ন অংশের অসংখ্য সাংবাদিক এবং হলিউড তারকা রিচার্ড গেয়ারের মতো অগণিত ভক্ত-সমর্থক।
বক্তৃতায় দালাই লামা জানান, তিনি কোথায়, কার শরীরে পুনর্জন্ম নেবেন রীতি মেনে তিব্বতি বৌদ্ধ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে গাদেন ফোদরাং ট্রাস্টই তা ঠিক করবে। দালাই লামা প্রথা বজায় রাখতে ও তার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে তিনিই এই ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
“পুরনো রীতি মেনে তারাই (গাদেন ফোদরাং ট্রাস্ট) নতুন দালাই লামাকে খুঁজবে ও তাকে শনাক্ত করবে। এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আরও কারও নেই,” বলেছেন তিনি।
তিব্বতি বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে, জ্যেষ্ঠ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের আধ্যাত্মিকতার ধারাবাহিকতা রাখতে মৃত্যুর পর কোনো এক শিশুর শরীরে পুনর্জন্ম নেন।
১৯৩৫ সালের ৬ জুলাই ছিংহাই প্রদেশে এক কৃষক পরিবারে লামো ধোন্দুপ নামে জন্ম নেন এখনকার দালাই লামা।
ত্রয়োদশ দালাই লামার মৃত্যুর পর একটি সার্চ পার্টি বেশ কিছু লক্ষণের ভিত্তিতে ২ বছর বয়সী শিশু ধোন্দুপের মধ্যেই আগের ধর্মগুরু পুনর্জন্ম নিয়েছে বলে ঘোষণা দেয়, বলছে দালাই লামার ওয়েবসাইট।
সাম্প্রতিক বিশ্বে যে ক’জন ধর্মগুরু নিজের ধর্মের বাইরেও বেশ সমাদৃত, দালাই লামা তার একচন। ১৯৮৯ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
গাদেন ফোদরাং ট্রাস্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সামদং রিনপোচে সাংবাদিকদের জানান, দালাই লামার শরীর ভালো আছে, এবং তিনি এখন পর্যন্ত উত্তরসূরি নিয়ে লিখিত কোনো নির্দেশনা দেননি।
দালাই লামা বলেছেন, তার উত্তরসূরি ছেলেও হতে পারে, মেয়েও হতে পারে, এবং তার জাতীয়তা কেবল তিব্বতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এমনটাও নয়।
এদিকে চীন বলছে, ঐতিহ্য মেনে তিব্বতিদের নেতা বেছে নেওয়ার অধিকার কেবল বেইজিংয়েরই রয়েছে। ছিং রাজবংশের সময়, ১৭৯৩ সাল থেকে অনেকদিন স্বর্ণপাত্রে রাখা সম্ভাব্য কিছু নাম থেকে একটি বেছে নেওয়া হতো, সেই হতেন নতুন ধর্মগুরু।
চীনা কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, দালাই লামার পুনর্জন্ম নির্ধারিত হওয়া উচিত জাতীয় আইন অনুসারে, যেখানে ‘সোনার পাত্র’ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা এবং নতুন নেতার পুনর্জন্ম যে অবশ্যই চীনের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে হতে হবে, তা বলা আছে।
ভারতে নির্বাসিত তিব্বতি সরকার, সেন্ট্রাল তিব্বতিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের নেতা পেনপা ৎসেরিং বলেছেন, চীনের দিক থেকে কোনো বিধিনিষেধ না থাকলে এবং স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে দালাই লামা তিব্বত ভ্রমণে যেতেও পারেন।
নির্বাসিত তিব্বতিদের জন্য থাকা তহবিলের ওপর কিছু বিধিনিষেধ যুক্তরাষ্ট্র তুলে নিয়েছে এবং এর পাশাপাশি তিব্বতি সরকার অর্থের আরও বিকল্প উৎস খুঁজছে বলেও তিনি জানান।
বিশ্ব বাণিজ্যে চীনের প্রাধান্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হওয়া যুক্তরাষ্ট্র এর আগে বারবারই বলেছিল, তারা তিব্বতিদের মানবাধিকার নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর। দালাই লামার উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের হস্তক্ষেপ মানা হবে না বলেও এর আগে অনেক মার্কিন আইনপ্রণেতা চীনকে সতর্ক করেছিলেন।