লেখা:বাদল সৈয়দ
১। আমার মেয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট দিলেই আমি জিজ্ঞেস করি, তোর অন্য বন্ধুদের রেজাল্ট কী রকম? ওর মতো তোর ভালো হলো না কেন?
ইদানীং মনে হচ্ছে, আমি একটি ভুল ঘোড়ায় চড়ে বসেছি, যেটা আমাকে ভুল গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছি। আমি প্রতিযোগিতা করছি আমার মেয়েকে নিয়ে অন্যের বাচ্চার সাথে। যেন বাচ্চা একটি ফুটবল, তাকে নিয়ে আমার গোল দিতে হবে। এরচে বড়ো ভুল আর কিছু নেই। সব কিছু নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, ক্যারিয়ার, পড়াশুনা, খেলাধুলা, কিন্তু বাচ্চাকে নিয়ে নয়। প্রতিটি বাচ্চা ইউনিক। সে তার মতো হবে। গোলাপ যেমন গোলাপের মতো, বর্ষাস্নাত কদম কদমের মতো। দুটোর সৌন্দর্য আলাদা। দুটোই অপূর্ব। এদের একটার সাথে আরেকটাকে মেলাতে গেলেই এরা অস্তিত্ব হারাবে। বাচ্চার মানস ধ্বংস করার জন্য হীনম্নন্যতাই যথেষ্ট এবং হীনম্নন্যতা তৈরির জন্য এ প্রতিযোগিতার চেয়ে বাজে আর কিছু নেই।
২। প্রতিটি বাচ্চা অসীম সম্ভাবনার বারুদ নিয়ে জন্মায়। আমরা ছোটো বেলাতেই যদি জোর করে সব বারুদ জ্বালিয়ে দেই তাহলে পরবর্তী জীবনে যখন এ বারুদের খুব দরকার হবে, তখন জ্বালানোর জন্য কোনো বারুদ অবশিষ্ট থাকবে না।
৩। ক্লাস ওয়ান থেকে এইট পর্যন্ত রেজাল্ট নিয়ে কেন আমি মাথা খারাপ করছি? আমার জীবনে কখনোও কি কেউ এসব রেজাল্ট দেখতে চেয়েছেন? চাকুরির জন্য? স্কলারশিপের জন্য? দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য? চাননি। তাঁরা চেয়েছেন পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্ট। এসএসসি থেকে যার শুরু। তাহলে এর আগের রেজাল্ট নিয়ে নিজেরই বা ব্লাড প্রেশার বাড়ালাম কেন? মেয়েটারই বা মাথা খারাপ করে দিলাম কেন?
৪। আমার মেয়ে ১০০ এর মধ্যে ৯০ পাওয়ার পর কেন ১০০-ই পায়নি তা নিয়ে রাগ করেছি। একবারও ভাবিনি সে ১০০ এর মধ্যে ৯০-ই ঠিকঠাক উত্তর দিয়েছে। নাইনটি পার্সেন্ট পারফেকশন! তারপরও আমার তৃপ্তি হয়নি!
৫। আমি আশা করেছি আমার বাচ্চা সব সময় সব ক্ষেত্রে প্রথম হবে; কিন্তু আমি ভুলে গেছি আমার মেয়েই পৃথিবীর একমাত্র হীরে নয়। কালিদাসের ভাষায় দুনিয়া হচ্ছে অসংখ্য হীরক খন্ডের সম্মিলন। সেসব হীরের টুকরাদের কেউ কেউ আমার মেয়েকে টপকাতেও পারে। ইতিহাস ঘাটলে কেউ সারাজীবন কেবল ফার্স্ট হয়েছে এমন রেকর্ড পাওয়া যাবে না। অথচ আমি চাইছি আমার মেয়েকে প্রথম হতেই হবে। যেন সে-ই এ দুনিয়ায় একমাত্র কোহিনুর হীরা! কী অসম্ভব বাজে একটি আবদার!
৬। আমি মেয়েকে নেপোলিয়নের সে বিখ্যাত উক্তি ‘আমার অভিধানে না শব্দটি নেই’- শুনিয়ে বারবার বলেছি সব কিছুতেই জয়ী হতে হবে। পরাজয়ের অর্থ হচ্ছে ‘না’- এটা তোমার অভিধানে থাকা চলবে না। অথচ একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখতাম নেপোলিয়ন নিজেই ওয়াটার লু যুদ্ধে করুণভাবে হেরেছিলেন। তাঁর জীবনটাই শেষ হয়েছে দ্বীপান্তরে যুদ্ধবন্দি হিসেবে এক বিশাল ‘না’ এর মধ্যে। আমার বোঝা উচিত ছিল জয় এবং পরাজয় হচ্ছে যমজ ভাই-বোন। এদের সাথে নিয়েই আমার বাচ্চাকে চলতে হবে।
৭। আমি চেষ্টা করছি আমার অপূর্ণ স্বপ্ন মেয়ের উপর চাপিয়ে দিতে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারিনি, তাই চাইছি ও তাই হোক। কিন্তু প্রতিটি মানুষ আলাদা। তার স্বপ্নও আলাদা। তাই তাকে আমার স্বপ্নের ছায়ায় বড়ো করার চেষ্টা মানে তার স্বপ্নকে হত্যা করা- এ চেষ্টা প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়।
৮। আরেকটি বেঠিক কাজ করেছি, তাহলো বাচ্চাকে সব সময় ‘স্যানিটাইজড’ পরিবেশে রেখে। চার দেয়ালের নিরাপদ পরিবেশ, ভালো স্কুল, সব ভালোর মধ্যে তাকে সব সময় রেখেছি। এটা অন্যায় নয়; তবে পুরোপুরি ঠিকও নয়, উচিত কাজটি হচ্ছে ‘সুন্দর’ দেখানোর পাশাপাশি বাইরের দুনিয়া যে এত সহজ নয় তাও তাকে বুঝিয়ে দেওয়া। চার দেয়ালের বাইরের পরিবেশ স্যানিটাইজড নয়- সেটা তাকে বুঝানো বড়ো দরকার, তাহলেই সে লড়াইয়ে টিকে থাকবে।
তাকে বলতে হবে ‘বাবা, ভাতের থালায় মাংস যেমন থাকে, তেমনি থাকে ডাল, সবজি,এমন কী ঝাল মরিচ। দুনিয়াটাও আসলে টক ঝাল মিষ্টির সমাহার, কেবল গামলা ভর্তি রসগোল্লা নয়।’
আসলে বাচ্চা হচ্ছে চারা গাছ, আমার কাজ হচ্ছে তাতে সার আর পানি দেওয়া। এ সার আর পানি হচ্ছে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবিকতা। এগুলো ঢেলে দেওয়ার পর সে যে ফুল হয়েই ফুটুক না কেন- আমার তাতেই খুশি থাকা উচিত।
শুধু সে ফুলে যেন একটি ‘আত্মা’ থাকে।
পবিত্র মহৎ আত্মা।