কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন দেশ স্বাধীনের ৪৫ বছর পর দেশের হাজার সমস্যা রেখে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দিকে সরকার কেন বেশি ঝুঁকছে? আপনি কী বলেন?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৬০-৬৫ বছর পেরিয়ে গেছে। যারা তখন যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল তারা অনেকেই এখন বেঁচে নেই, যারা আছে তারাও খুব বৃদ্ধ। হয়তো চলাফেরাও করতে পারে না। তাদেরও কিন্তু খুঁজে বের করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। এ উদাহরণ তো আমাদের চোখের সামনেই আছে। কেন তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে? কারণ যারা তখন বিনা অপরাধে অত্যাচারিত হয়েছিল তার একটা জাস্টিস তো হতেই হবে। নয়তো কীসের মানবতা, কীসের সভ্যতা। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। এটা স্ট্যাবলিস্ট করতে না পারলে গোটা মানবতাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। পরবর্তী প্রজন্ম আস্থা হারিয়ে ফেলবে আইনের শাসনের ওপর।
একাত্তরে যা হয়েছিল তা ছিল মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর একটি অপরাধ। যতক্ষণ আমাদের দেশের অস্তিত্বের মধ্যে এই যুদ্ধাপরাধ, এই অন্যায় থাকবে ততক্ষণ আমরা এই পচা অংশটা নিয়ে চলতে পারব না। আমাদের অবশ্যই এটা থেকে মুক্ত হতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে স্পষ্টভাবে এ বার্তা দিতে হবে যে অপরাধীরা পার পাবে না, অন্যায় করে কেউ পার পাবে না।
আরেকটা জিনিস জানাতে হবে যে, আমরা একটা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি, আমাদের যে সব মানুষ জীবন দিয়েছেন, যেসব নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন, তারা আমাদের গর্ব। জাতির এই বীর সন্তানদের আমরা ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। যদি আমরা সেটা না করি তবে বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে কে দাঁড়াবে? কে জীবন দিতে যাবে? অতএব এটা ৪৫ বছর কেন, আমার মনে হয় এটা যদি ৪০০ বছরও লাগে তবু এই বিচার কাজ আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।
এমনও অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধী থাকা সত্ত্বেও সরকার তাদের বিচারের আওতায় আনছেন না। এ বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
একটি জিনিস আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। যখন কাদের মোল্লার বিচার হয় তখন কাদের মোল্লা দাবি করে যে, সে ‘কসাই’ কাদের না। ঢাকা শহরে আমি অজস্র শিক্ষিত মানুষকে বলতে শুনেছি ‘দেখেন তো কোথাকার এক লোককে এনে বলছে কসাই কাদের’!
অথচ মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছেন, যারা দেখেছেন তাদের অনেকেই জীবিত আছেন, মাত্র চার দশক পরে কেন তারা ভুলে যাবেন কোনটা কসাই কাদের? যে দেশে এখনও প্রশ্ন করা হয় গণহত্যা হয়েছিল কি না এবং যে দেশের একটি বড় দলের নেত্রী বলেন একাত্তরে এত লোক মারা যাননি, এত নারী অত্যাচারিত হননি, এটা কি গণনা করার বিষয়, এটা কি প্রশ্ন করার বিষয়? এটা আমাদের খুব কষ্টের জায়গা। প্রকাশ্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, নিজামী ও মুজাহিদরা সারা দেশ দাপিয়ে বেড়ালো, শত শত মানুষকে নির্যাতন করল, নারী নির্যাতন করল, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করল। অথচ বলা হলো, কেউ দেখেনি, কোনো সাক্ষীও নাকি নেই! এই কাদের মোল্লা নাকি সেই কাদের মোল্লা না, সাঈদীও নাকি সেই সাঈদী না। কত রকম যু্ক্তি। যারা এসব যুক্তি দেখাচ্ছেন তারা একজনও কিন্তু অশিক্ষিত লোক না। সমাজের অনেক ভারি ভারি লোকজনও রয়েছেন তাদের মধ্যে।
ইউরোপের প্রেক্ষাপট কিন্তু এক না। কোথায় যেন পড়েছি, জার্মান আদালতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক অপরাধী নির্দোষ প্রমাণিত হয়। এক নারী সেটা মেনে নিতে পারেননি। কারণ তার শৈশবের স্মৃতি বলছে, এই ব্যক্তিই সে অপরাধী যে তার দাদাকে এবং বাবাকে খুন করেছে। তিনিও তখন ওই ক্যাম্পেই ছিলেন এবং এটা দেখেছেন। তিনি তার সারাটা জীবন, চাকরি, প্রেম, সংসার সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে শেষ পর্যন্ত এটা প্রমাণ করে ছাড়েন।
আসলে নাগরিক হিসেবে আমরা স্ট্রং নই। আমাদের দায়িত্ব যেগুলো আছে, সেগুলো আমরা পালন করি না। বেশি দিন আগের ঘটনা তো নয়, আওয়ামী লীগের যত বড়ো নেতাই হন না কেন, নাগরিকরা যদি বলেন, এই লোকটা একাত্তর সালে অপরাধ করেছিল, আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল, এই নেতা রাজাকার ছিল- তাহলে পুরো ছবিটাই বদলে যেত। কিন্তু এ দায়িত্ববোধটা আসলে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে নেই। নেই বলেই এখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এমন একজন দায়িত্বশীল নেত্রীও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। এটা কিন্তু ব্রিটেন, জার্মানি কিংবা আমেরিকায় বলতে পারতেন না। বললে তার রাজনীতির ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে যেত চিরতরে।
এত বছর পরে এসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি একজন খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী হয়েও এই প্রশ্ন তোলা কতটা যুক্তিযুক্ত? এটা কী কেবলই রাজনীতির খাতিরে বলা?
আগেই বলেছি, দুটি রাজনীতি আছে। একটা বাংলাদেশের আদর্শ, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। আরেকটা আদর্শ এটার ঠিক বিপরীত। যে আদর্শকে আমরা একাত্তরে পরাজিত করেছিলাম। সেটা হলো পাকিস্তানিদের আদর্শ। আমি দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, যারা নানা কৌশলে এ ধরনের কথা বলেন, তারা বাংলাদেশের আদর্শকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। তাই এসব বলেন।
বঙ্গবন্ধুর পঁচাত্তরের খুনিদের কাউকে কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। এখনও অনেকেই বিভিন্ন দেশে পলাতক। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার পরও সে সব খুনিকে দেশে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। বাধাটা কোথায়?
আমি একজন সাধারণ নাগরিক, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তো জানি না। সাত বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে এবং এই সাত বছর তারা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই আছে। তবে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনতে যতটা তৎপরতা দেখানো উচিৎ আমার মনে হয়, আমি সেটা দেখিনি। আমাদের চেতনার ভিত্তিটা বোধহয় খুব বেশি শক্ত নয়। এটা শক্ত হলে একাত্তরের গণহত্যাকারীরা বা পঁচাত্তরের হত্যাকারীরা এই দেশ একুশ বছর শাসন করতে পারত না। মানুষ তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলত।
এবার আপনার লেখালেখি প্রসঙ্গে আসি। লেখালেখির শুরুটা কখন, কীভাবে করেছেন?
প্রথম কবিতাটি লিখি ১৯৭৩ সালে স্কুলে, পরীক্ষার খাতায়। একটি ঘটনা দেখে খুব মন খারাপ হয়েছিল। চট্টগ্রামের খুব ধনী একজন লোকের ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ত। পরীক্ষার হলে আমাদের এক শিক্ষক তাকে উত্তর বলে দিচ্ছিলেন। এটা দেখে হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি পরীক্ষার খাতায় উত্তর না লিখে কবিতার মতো কিছু একটা লিখে ফেললাম, এটা যে কবিতা জানতাম না। কবিতাটির নাম ছিল ‘হায়রে দুর্ভাগা দেশ’।
সে সময়ের আগ পর্যন্ত কি কখনও কবিতা লিখেছেন?
না, লিখিনি। আমি পড়ুয়া ছিলাম। ভালো স্টুডেন্টও ছিলাম, প্রথম দুই-তিন জনের মধ্যে ছিলাম। মুসলিম হাইস্কুলের মতো একটা স্কুলের শিক্ষক টাকার জন্য একজন ছাত্রকে উত্তর বলে দিচ্ছেন, এ ঘটনা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে। এই পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন ‘তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে’ খ্যাত গীতিকার আবদুল্লাহ আল মামুন। সে আমাদের সহপাঠী ছিল, আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়ও ছিল। এখন কাতার সরকারের প্ল্যানিং উপদেষ্টা। এর পরে এই ধরনের বহু কবিতা আমি লিখেছি। কিন্তু সেগুলোকে আমি কবিতা বলি না। ‘৭৫-এর পর থেকেই মূলত আমার প্রকৃত লেখালেখির শুরু। ১৯৮৩ সালে আমার প্রথম কবিতার বই ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু একমাসের মধ্যেই সেটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
বইটি নিষিদ্ধ করার কারণ কী?
বইটিতে বেশির ভাগ কবিতাই ছিল স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লেখা। সামরিক একনায়ক লে. জে. এরশাদকে নিয়ে একটি কবিতা ছিলো- ‘এই যে লোকটি তর্জন গর্জন করছে অবিরাম/ রণহুঙ্কারে হুঙ্কারে কাঁপাচ্ছে স্বদেশ/ জনতার মঞ্চে এসে শাসাচ্ছে কেবল/ এই লোকটি কে, হে বিজ্ঞ মানুষ তুমি কি বলতে পারো? জঙ্গলী পোশাক পরা, হাতে রাইফেল/ লেফট-রাইট লেফট-রাইট শব্দে কাঁপাচ্ছে স্বদেশ/জনতার মঞ্চে এসে শাসাচ্ছে কেবল/এই লোকটি কে?’। কবিতাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, আমাকে প্রায়ই চবি ক্যাম্পাসে কবিতাটি পড়তে হতো। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও অনেক কবিতা সেখানে ছিল।
বইটি কি পরে আবার প্রকাশ করতে পেরেছিলেন?
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর চেষ্টা করেছিলাম নিষেধাজ্ঞাটি প্রত্যাহারের জন্যে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখায় আবেদন করেছিলাম। তারা আমাকে বললেন, এটা সামরিক সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল, সেই ফাইলপত্র তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেক দৌড়ঝাঁপ করার পর বুঝতে পারলাম যে, এ বিষয়ে আমি কোনো সহযোগিতা পাবো না। বইটি তাই আর প্রকাশ করা হয়নি। তবে ওই বইয়ের কিছু কিছু কবিতা যেগুলো জনপ্রিয় হয়েছিল সেগুলো আমার নির্বাচিত কবিতার বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছি।