বিজয়ের ইতিহাস: সাইফুর মিশু

Date:

Share post:

সাইফুর আর মিশু ৷
স্যাম মানেকশ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিল খুলনা এবং চট্টগ্রাম দখল করে নেয়ার জন্য, ঢাকার পতন ঘটবে এমনিতেই। ভিন্ন মতামত ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ণ কমান্ডের তৎকালীন চিফ অফ আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকবের। অন্য শহর দখল না করে সরাসরি ঢাকা দখল করে নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। তার যুক্তি ছিল অন্য শহর দখল নিয়ে বসে থাকার মত সৈন্যবল তার ছিলো না, এবং ঢাকা যতক্ষণ দখল হচ্ছে না ততক্ষণ বিজয়ের সম্ভাবনা কম। পাশাপাশি এত ক্ষয়ক্ষতির পরে ঢাকা পতনের জন্য অপেক্ষা করাটা বিলাসিতা মনে হয়েছে তার কাছে।
চুড়ান্ত বিজয়ের পুরো পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। তাদেরকেই পুরো কৃতিত্ব দিয়েছেন জ্যাকব তার সাক্ষাৎকারে। সীমানা পাড়ি দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের ভিতর পাকিস্তানী কোন গুপ্তচর ঢুকে পরার সম্ভাবনার ব্যাপারে জ্যাকব জানিয়েছিলেন, তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সাপোর্টের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিনিধিরাই এই ব্যাপারে সহায়তা করতেন। উল্লেখ্য, টিক্কা খান ছিল জ্যাকবের ছাত্র। মিলিটারি কলেজে তিন মাস জ্যাবকের অধীনেই প্রশিক্ষণ নিয়েছে টিক্কা খান। টিক্কা খানের রণকৌশল সম্পর্কে ধারণা করতে পারতেন তিনি।
২৬৪০০ পাকিস্তানী সেনার বিরুদ্ধে মাত্র ৩০০০ হাজার সেনা নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন জ্যাকব। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের সাথে তখন ঢাকার আশপাশের সম্মুখ যুদ্ধ চলছে মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেদের। এমন অবস্থায় ১৪ই ডিসেম্বর গভর্ণর ভবনে মালেক তার মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দসহ গোপন বৈঠকে বসার খবর পেয়ে যায় মিত্রবাহিনী। তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে বেলা ১১টায় শুরু হওয়া বৈঠকে, মেঘালয়ের শিলং বিমান ঘাটি থেকে প্রেরিত ৬টি মিগ-২১ আক্রমণ চালায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। বিমান থেকে ছোড়া রকেট বোমা গুলো যখন একের পর এক আছড়ে পড়ছে ছাদের উপর, উপস্থিত মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ এবং মালিক প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলো ভয়ে। হুলুস্থুল শুরু হয় গভর্নর ভবনে।
বৈঠকে উপস্থিত পুলিশের আইজি এবং চীফ সেক্রেটারীসহ যত বড় বড় কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলো সকলেই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। বিমান হামলা শেষ হতেই আবারো বৈঠকে মিলিত হলো মালিক এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। ইতিমধ্যে তারা পাকিস্তান সেনাপ্রধান প্রেরিত একটি চিঠি তাদের হাতে পৌঁছায় যা পাঠানো হয়েছিলো নিয়াজি এবং গভর্ণরের কাছে। উক্ত চিঠি এবং তার কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া বিমান হামলার দরুন বৈঠক শুরুর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় তাদের পরবর্তী করণীয় কি হবে সে ব্যাপারে।
মালিক এবং তার মন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত নিলো পদত্যাগ করার। সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করেই তারা ঢাকাস্থ আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের তৎকালীন প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করে আশ্রয় প্রার্থনা করে। ঢাকাস্থ আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের (ICRC) প্রধান স্ভেন লামপেল (Sven Lampell) নিজে গভর্ণর হাউজে (বঙ্গভবন) হামাগুড়ি দিয়ে (তখন ভুলবশতঃ ভারতীয় বিমান বোমাবর্ষণ করছিল) পাতাল ঘর থেকে মালিকের দলবল সহ উদ্ধার করে ইন্টারকন্টীনেন্টালে আশ্রয় দেয়।
বিস্তারিত: (http://bit.ly/2fXzSSk )।
১৬ই ডিসেম্বর নিয়াজির সাথে দেখা করেন জ্যাকব। সকলের সামনে থেকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে তাকে ত্রিশ মিনিট সময় বেঁধে দিয়ে আত্মসমপর্ণ করতে বলেন। নিশ্চয়তা দেন শর্তহীন আত্মসমর্পণ করলেই কেবল ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দিবে এবং জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যথাযথ সম্মান দেয়া হবে। নতুবা মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাদেরকে কিছু করলে তার কোন দায় ভারতীয় বাহিনী নিবে না। জানা যায় সে সময় নিয়াজির চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। জ্যাকব সে সময় পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলেন না, নিয়াজি আদৌ রাজি হবে কী না। অপরদিকে জেনারেল অরোরার একটি সাক্ষাৎকার এবং তৎকালীন সংবাদ সম্মেলন হতে জানা যায় তিনিও সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান।
নিয়াজির সাথে দেখা করার পূর্বেই জ্যাকব আত্মসমপর্ণের দলিল প্রস্তুত করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেনা প্রধান স্যাম মানেকশকে। স্যাম মানেকশ টেলিফোনে জ্যাকবকে বলেন অনতিবিলম্বে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করানোর জন্য। জ্যাকব আরও বলেন এর আগে কয়েকদিন যাবত নিয়াজির সাথে ওয়ারলেসে কথা হচ্ছিল তার। নিয়াজিকে নিয়ে গাড়ীতে রেসকোর্সের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা গাড়ির সামনেই হামলে পড়ছিল। শুধুমাত্র জ্যাকবের অনুরোধে এবং আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে আশ্বস্ত করার পর ছেড়ে দেয়। রাস্তায় নেমে আসা বাঙ্গালীদের ভিড় ঠেলে নিয়াজিকে নিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে রেসকোর্সের দিকে ইতিহাস রচনার লক্ষ্যে। জ্যাকবের ব্যক্তিগত টাইপ রাইটারেই করা তার তৈরি করা ড্রাফটেই সাক্ষরিত হয়েছিল যুদ্ধের ইতিহাসের একমাত্র জনসম্মুখে হওয়া আত্মসমর্পণ। রচিত হয়েছিল ইতিহাস। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের চুড়ান্ত বিজয়ের আনুষ্ঠানিকতা সময় নিয়েছিল মাত্র ৪ ঘন্টা।

সূত্রঃ অরোরা এবং জ্যাকবের সাক্ষাৎকার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আবারো এস আলমে আগুন 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় এস আলম গ্রুপের চিনির গুদামের পর এবার তেলের মিলে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের...

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...