ডা. ফয়সাল ইকবাল আতংকে চমেক হাসপাতাল।

Date:

Share post:

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে সাধারণ ডাক্তারদের কাছে আতংকের নাম ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী। চমেক হাসপাতালের ডাক্তার না হয়েও তিনি এখানে সদর্পে ছড়ি ঘোরান। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার যুগ্ম সম্পাদক ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) কেন্দ ীয় কমিটির সহ-সম্পাদক হওয়ায় ফয়সাল ইকবাল কাউকে পরোয়া করেন না। তাই অনেকটা নির্বিঘেœ তিনি চমেক হাসপাতালের নিয়োগ-বদলি, ঠিকাদারি থেকে শুরু করে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তার সবুজ সংকেত না মিললে যেমন কেউ এখানে যোগদান করতে পারেন না, তেমনি চমেক হাসপাতালে কোনো ডাক্তার তার বিরাগভাজন হলে তাকে দ্রুত বদলির শিকার হতে হয়। চমেক হাসপাতালের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ডা. মিজানসহ ট্রিপল মার্ডার মামলার আসামি হিসেবে হাসপাতালে উত্থান হওয়া এই ডাক্তারের বিরুদ্ধে চিকিৎসক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন মহলের এন্তার অভিযোগ থাকলেও কেউই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেন না। কারণ তিনি সরকারি দল সমর্থক ডাক্তারদের প্রভাবশালী নেতা। কেউ সরকারি দলের কট্টর সমর্থক কিংবা নেতা হলেও চমেক হাসপাতালে থাকতে হলে ডা. ইকবালকে সমীহ করে চলতে হয়। উগ্র মেজাজি হওয়ার কারণে সরকারি দল সমর্থিত অনেক চিকিৎসকও তার কাছে প্রায় অপমান-অপদস্থ হন। কিন্তু এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করতে পারেন না। বিএমএ নির্বাচনে ব্যালট বাক্স কেড়ে নিয়ে নিজের প্যানেলের সাধারণ সম্পাদককে জেতানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাধারণ চিকিৎসক, বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনসহ ভুক্তভোগীদের কয়েকজন বলেন, ডা. ইকবাল নানাপন্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ বিত্তবৈভবের মালিকও হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরীর বাড়ি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নের ধামইরহাট। তার পিতা মৃত নূরুল আবছার চৌধুরী। ১৯৯২ সালে ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি থাকা অবস্থায় তিনি হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান আসামি হন। ওই বছরের ১৯ অক্টোবর চমেক হাসপাতালের ক্যাফেটেরিয়ার সামনে ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মিজান নামে একজন ইন্টার্নি ডক্টর এবং বোরহান উদ্দিন ও ফরিদ নামে চমেক হাসপতালে আসা রোগীর দুই স্বজনের মৃত্যু হয়। অভিযোগ ছিল, আধিপত্য বিস্তার এবং হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্যই চমেক ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি সেকান্দর হোসেনকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভুল টার্গেটে একজন ইন্টার্নি ডাক্তার ও অপর দু’জন নিরীহ লোকের মৃত্যু হয়। সূত্র মতে, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিলেন ডা. ফয়সাল ইকবাল। ‘নীল শার্ট’ পরা সেই লোকই সেকান্দর; এমন তথ্যের ভিত্তিতে কিলাররা তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে। অর্থাৎ ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তথ্য দেয়া হয় নীল শার্ট পরা ব্যক্তিই ছাত্রদল নেতা সেকান্দর। এমন তথ্যের ভিত্তিতেই পরপর তিনজনকে গুলি করে কিলাররা। এতে ডা. মিজানসহ তিনজনের মৃত্যু হলেও ছাত্রদল নেতা সেকান্দর ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এই মামলায় অন্যদের সঙ্গে ডা. ফয়সাল ইকবালও ছিলেন অন্যতম প্রধান আসামি। হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পর তিনি ভারতে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে দেশে ফিরে এলে ওই মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। বেশ কিছুদিন জেল খাটার পর তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। পরবর্তীকালে সাক্ষীর অভাবে এই মামলার সব আসামি আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে যান। সাক্ষীদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর কারণে তারা আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, এরই মধ্যে ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী ডাক্তারি পাস করে বের হয়ে ’৯৯ সালে যোগ দেন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে ইএমও বা ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন তিনি। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকতে হয়নি তাকে। প্যাথলজি বিষয়ে ২ বছরের একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের বা এমফিলের (প্যাথলজি) জন্য শিক্ষা ছুটি নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফিরে আসেন। ২০০৪ সালে ওই কোর্স শেষ হয়ে গেলেও চমেক হাসপাতালে তার আধিপত্য ও উপস্থিতি এখনও নিরঙ্কুশ। এও অভিযোগ আছে, এখানে এমফিল শেষ হলেও যেমন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তথা তার মূল কর্মস্থলে যোগ দেননি, আবার যোগ না দিলেও তিনি সেখান থেকে বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে প্রমোশন নিয়ে আসা একাধিক চিকিৎসক ফয়সাল ইকবাল চৌধুরীর কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধায় এখানে যোগ দিতে পারেননি। এর মধ্যে একজন চিকিৎসক ক্ষোভ ও হতাশা থেকে রীতিমতো চাকরি ছেড়ে দেশত্যাগ করেছেন। এই চিকিৎসকের নাম মো. শাহাবুদ্দিন। সূত্র জানায়, ডা. শাহাবুদ্দিন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নিয়মিত দায়িত্ব দিয়ে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু তিনি যোগ দিতে পারেননি। জানা গেছে, শাহাবুদ্দিন দেশের একজন নামকরা হিস্ট্রোপ্যাথলজিস্ট। চট্টগ্রামে এ ধরনের চিকিৎসক খুবই কম। একই বিভাগে শিক্ষা ছুটিতে এমফিল কোর্সে থাকা ফয়সাল ইকবাল পরোক্ষভাবে তার যোগদান ঠেকিয়ে দেন বলে চমেক হাসপাতালে চাউর আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই অপমান ও ক্ষোভে এক পর্যায়ে চাকরিই ছেড়ে দিয়ে কানাডা চলে যান এই চিকিৎসক। একই বিভাগে আরেক চিকিৎসক ডা. সুকুমার নন্দীকেও যোগ দিতে দেয়া হয়নি। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে তিনি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘুরলেও যোগ দিতে পারেননি।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তথা শিশু বিশেষজ্ঞও ডা. ফয়সাল ইকবালের রোষানলে পড়ে বদলি হন। পরে পুনঃবদলি নিয়ে তিনি চমেক হাসপাতালে ফিরে এলেও তার কক্ষে নিজ হাতেই তালা লাগিয়ে দেন ফয়সাল। উৎপল বড়–য়া নামে ফটিকছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আরেক চিকিৎসকও চমেক হাসপাতালে বদলি হন। কিন্তু ফয়সাল ইকবালের সিগন্যাল না থাকায় তিনিও যোগ দিতে পারছেন না। চমেক হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে ডা. ফয়সাল ইকবালের কারণে অনেক চিকিৎসক, বদলি পদোন্নতি কিংবা কর্মস্থলে নানা হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হলেও ভয়ে কেউ প্রভাবশালী এই চিকিৎসকের নামই মুখে আনতে চান না।
কেবল চিকিৎসকদের হয়রানিই নয়; চমেক হাসপাতালের কোটি কোটি টাকার খাবার সরবরাহ, আউট সোর্সিং ব্যবসাসহ বিভিন্ন সরবরাহ কাজের টেন্ডারও নিয়ন্ত্রণ করেন ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী। নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্যাডে তিনি প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজের টেন্ডার বাগিয়ে নেন। এ ক্ষেত্রে জটিল ও কঠিন শর্ত সংযোজন করে বাইরের ঠিকাদারকে যেমন তিনি টেন্ডারে অংশ নিতে দেন না তেমনি কেউ অংশ নিলেও প্রয়োজনে তিনি নেগোসিয়শনের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নেন। এটি করতে গিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। প্রায় ১৫ বছর ধরেই এভাবে চমেক হাসপাতালে ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরীর আধিপত্য চলছে বলে জানা গেছে। কেবল চমেক হাসপাতাল নয়; জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-ইউএসটিসিসহ বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজেও তিনি অবৈধ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অস্থির করে রাখেন বলে অভিযোগ আছে। আর সবকিছুই তিনি করেন বিএমএ ও স্বাচিপের নাম ভাঙিয়ে। আওয়ামী লীগপন্থী কট্টর চিকিৎসকদের পাশাপাশি সাধারণ চিকিৎসকরাও তার এসব কর্মকাণ্ডের ঘোর বিরোধী।
এর আগে ২০১২ সালে বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার নির্বাচনে ফলগণনার সময় ব্যালটবাক্স কেড়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটে। নিজের প্যানেলের লোকজনকে জেতাতে ডা. ফয়সাল ইকবাল নিজেই ফল গণনার সময় ব্যালট বাক্স কেড়ে নিয়ে ফলাফল উল্টে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই ঘটনায় সংক্ষুব্ধ প্রতিপক্ষ আদালতে মামলাও দায়ের করেন। পরবর্তীকালে মামলার রায় বাদীর পক্ষে আসে। ফলাফল কারচুপি করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়।

সংগৃহীত:দৈনিক যুগান্তর।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আবারো এস আলমে আগুন 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় এস আলম গ্রুপের চিনির গুদামের পর এবার তেলের মিলে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের...

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...