মিনার মনসুর
দুনিয়াকাঁপানো সোনাঝরা বিপ্লবের সেইসব দিন হয়ত আর ফিরে আসবে না। এমনকি ধূসর হতে চলেছে সমাজবিপ্লবের উত্তাল সেই স্বপ্নও। বিপ্লবের মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র যাদের ঘুমাতে দিত না- ডাকাবুকো সেই কিশোর-তরুণ-যুবকেরা এখন কোথায় কী কাজে নিয়োজিত জানি না। বিপ্লবের গোপন ও প্রকাশ্য আখড়াগুলোয় তালা ঝুলছে বহুদিন। মার্কস, লেনিন, ম্যাক্সিম গোর্কি, নিকোলাই অস্ত্রভস্কি, পাবলো নেরুদা, নাজিম হিকমত ও মায়াকোভস্কির অগ্নিবর্ণের বইগুলোর ওপর জমে আছে পুরু ধুলোর আস্তরণ। নামমাত্র মূল্যে এসব বই বিক্রি করে নিষ্কলুষ হাসিমাখা মুখে যারা শাদামাটাভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাদের অনেকেই এখন কর্পোরেটের জমকালো রথে চেপে বসেছেন। কেউ-বা ফেঁদে বসেছেন নোট-গাইড বইয়ের জমজমাট ব্যবসা। তারপরও আমৃত্যু আমাদের প্রজন্মের যে গৌরবপতাকা কখনোই অর্ধনমিত হবার নয় তাহলো- আমরা ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে দেখেছি। দেখেছি বিপ্লবের অজেয় অপ্রতিরোধ্য শক্তিমত্তা।
বিশ্ববিপ্লবের জন্যে জীবন উৎসর্গ করে ফিদেলের বন্ধু ও সহযোদ্ধা চিরতরুণ চে গুয়েভারা গান হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন চিরকালের আকাশে। সে এক অধরা মাধুরী। কিন্তু ফিদেল তা নন। বিপ্লবকে ভাষা শুধু নয়, দিয়েছেন রক্তমাংসের অবয়ব। তিনি হলেন বিপ্লবের যুধিষ্ঠির। মহাবিপর্যয়ের মুখে একে একে রাশিয়া-চীনসহ সব মহারথীর যখন পতন হচ্ছিল, তখনো আকাশ ছুঁয়ে দণ্ডায়মান ছিল তাঁর চির উন্নত শির। বিপ্লবের ঘি-মধু খেয়ে যারা পুষ্ট হয়েছেন তারাও যখন বিপ্লবের মহান স্বপ্নকে পরিত্যক্ত শিশুর মতো পথে ছুড়ে ফেলে ডলারের দেবতার কাছে আত্মনিবেদন করছিলেন- তখনো লালপতাকা হাতছাড়া করেননি তিনি। বিপ্লবের সবচেয়ে বড় শত্রুর ভয়ঙ্কর থাবার নিচে বসে কয়েক দশকের অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে বিপ্লব কোনো আকাশকুসুম কল্পনা নয়। জনতার হৃদয়ে যার অধিষ্ঠান সেই বিপ্লবের বিনাশ নেই। ব্যক্তিমানুষ পরাস্ত কিংবা পথভ্রষ্ট হতে পারে, কিন্তু সমাজ বদলের যে বিপ্লব, তাকে কেউ পরাস্ত করতে পারে না। এখানে ফিদেল ছাড়িয়ে গেছেন তাঁর পূর্ববর্তী ও সমকালের বহু বড় বড় বিপ্লবীকেও।
ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে পঞ্চাশের দশকে-সামরিক একনায়ক বাতিস্তার (Fulgencio Batista y Zaldívar) স্বৈরশাসন কবলিত কিউবায়। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। শরণাপন্ন হয়েছিলেন মহামান্য আদালতের। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্র সেদিনের তরুণ আইনজীবী ফিদেল যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে কিউবার আদালতে বলেছিলেন, কোনো প্রকার সামরিক বা স্বৈরশাসন দেশটির সংবিধান অনুমোদন করে না। অতএব, রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে আদালতের কর্তব্য হলো বাতিস্তার শাসন অবৈধ ঘোষণা করা। কিন্তু বন্দুকের নলের সামনে ত্রস্ত আদালত তা করতে ব্যর্থ হয় ন্যাক্কারজনকভাবে। তখন ক্ষুব্ধ ফিদেল আদালতের সম্মুখে যে-দীর্ঘ বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন তা পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী। বাংলায়ও তা অনূদিত হয়েছিল। ‘ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে আমার ভূমিকা সঠিক ছিল’ শিরোনামের ছোট্ট সেই পুস্তিকাটি দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
কিউবার সংবিধান হাতে নিয়ে আদালতের উদ্দেশ্যে ফিদেল বলেছিলেন, যদি সংবিধান লংঘিত হয় তাহলে নাগরিকদের কর্তব্য হলো আদালতের কাছে প্রতিকার চাওয়া। কিন্তু আদালতও যদি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে নাগরিকের কর্তব্য হলো অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। অবতীর্ণ হওয়া সশস্ত্র প্রতিরোধ-যুদ্ধে। যেহেতু ফিদেল আদালতে প্রতিকার চেয়েও পাননি তাই দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে তিনি তাঁর কর্তব্য পালন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ফিদেলের নেতৃত্বে সশস্ত্র পন্থায় ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করে কিউবায় যে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বস্তুত এটাই ছিল তার ভিত্তিভূমি। ভাবুন তো একবার, সেদিনের মাত্র ৩৫ বছর বয়সী ফিদেল কী আশ্চর্য প্রজ্ঞার সঙ্গে সশস্ত্র বিপ্লবকেও শক্ত আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পাশাপাশি এও মনে রাখতে হবে যে সেটা ছিল বিপ্লবের যুগ। এ লক্ষ্যে সশস্ত্র পন্থায় ক্ষমতা দখলের পথে হেঁটেছিলেন আরও অনেকেই। তাতে সফলও হয়েছেন কেউ কেউ। তাদের প্রায় সকলেরই শোচনীয় পরিণতি যে নির্মম সত্যটির দিকে অঙুলি নির্দেশ করে তা হলো, বিপ্লব করার চেয়ে বহুগুণ কঠিন কাজ হলো বিপ্লব বাঁচিয়ে রাখা। রুশ বিপ্লবের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল সেই বিপ্লবের স্থপতি ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনকেও। সেই চ্যালেঞ্জে তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেও পরবর্তীকালে পঞ্চাশোর্ধ্ব সফল সেই বিপ্লবের কী দশা হয়েছে তা কারো অজানা নয়। অথচ রুশ বিপ্লব শুধু বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল বৈষম্য ও দুর্দশাপীড়িত সমাজের খোলনলচেই বদলে দেয়নি, একই সঙ্গে ভরসার কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বের তাবৎ নিপীড়িত মানুষেরও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন এ মহান দেশটির চালকের আসনে যারা ছিলেন তারা কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নকে নরকের আগুনে ছুড়ে ফেলতে একটুও দ্বিধা করেননি। সেদিন কে কী করেছেন ইতিহাসের ত্রিকালদর্শী চোখের ক্যামেরায় তা তোলা আছে চিরকালের জন্যে। বলা বাহুল্য যার যা প্রাপ্য ইতিহাস তা কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে এবং দেবে।
ফিদেলের অনন্যতা এখানেই যে তরুণ বয়সে যে-বিপ্লবের আদর্শ তিনি শিরোধার্য করেছিলেন আমৃত্যু তা থেকে বিচ্যুত হননি। একদিকে দুর্গম পথযাত্রার সঙ্গী-সাথীদের পতন হয়েছে একে একে, অন্যদিকে বারবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে, ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে (বিপ্লবের প্রশ্নে) দুর্বিনীত কিউবাকে; কিন্তু মাথা নত করেননি ফিদেল। মৃত্যুর সার্বক্ষণিক ঝুঁকি যেমন তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে, তেমনি ছিল প্রলোভন-প্ররোচনার অজস্র হাতছানি। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মোড়লদের কাছে উচ্চমূল্যে নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারতেন তিনি। কিন্তু পর্বতপ্রমাণ চাপের মুখেও ঘুণাক্ষরেও ফিদেল তা ভাবেননি। ফলে তিনি শুধু কিউবার জনগণের ভরসার উৎস ছিলেন না, বরং দশকের পর দশক ধরে প্রেরণার অশেষ ঝরনাতলা হয়ে ছিলেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
বিশ্বের বর্বরতম হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশ যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল একাত্তরে তার নেপথ্যে বঙ্গবন্ধুর পাশে ফিদেলও ছিলেন। শুধু স্বাধীনতা নয়, সমাজতন্ত্রই ছিল এদেশের মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্য। শুধু যে সংবিধানেই তা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তাই-ই নয়, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও মূর্ত হয়ে উঠেছিল সেই স্বপ্ন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাৎপর্যপূর্ণ দুটি শব্দ তিনি উচ্চারণ করেছিলেন: স্বাধীনতা ও মুক্তি। স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের জীবৎকালে বিশদভাবে তিনি ‘মুক্তি’ শব্দটির ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। একপর্যায়ে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে পা-ও বাড়িয়েছেন সেই প্রত্যাশিত মুক্তির পথে। ঘোষণা করেছেন তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি। কিন্তু মানবেতিহাসের অন্যতম নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে থামিয়ে দেওয়া হয় সেই বৈপ্লবিক পথযাত্রা।
সাম্রাজ্যবাদের উপর্যুপরি ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ফিদেল এ ব্যাপারে সাবধানও করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা তা গ্রাহ্য করেননি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ফিদেল কতোটা উচ্ছ্বসিত ছিলেন তা অনেকেরই জানা। তাঁর সেই উক্তি তো বিস্মৃত হওয়ার মতো নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বতমালা দেখিনি। কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় এই মানুষই হিমালয়। এভাবে আমার হিমালয়ও দেখা হয়ে গেল।’ বঙ্গবন্ধু যদি ফিদেলের পরামর্শ গ্রহণ করতেন তাহলে বাংলার ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে রচিত হতো। তবে নেতা হিসেবে উভয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট যে পার্থক্যরেখাটি রয়েছে তাও বিস্মৃত হওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু হলেন আপাদমস্তক জনগণের নেতা। এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নিরস্ত্র জনতাকে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথে পরিচালিত করেছিলেন। আর ‘কমান্দান্তে’ ফিদেল সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে ক্রমে জয় করে নিয়েছিলেন জনতার হৃদয়-মন।
ফিদেল কেবল আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরই অন্যতম নেপথ্য বাতিঘর ছিলেন না, বরং বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী ভয়াল অন্ধকার দিনগুলোতেও তিনি আমাদের সাহস জুগিয়েছেন। এ-কথা শুনে কেউ কেউ চমকে উঠতে পারেন। তবে আমি নিশ্চিত যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে জগদ্দল পাথরের মতো জাতির ওপর চেপে বসা স্বৈরশাসনবিরোধী রণাঙ্গনের সৈনিক মাত্রই এ-সত্য অকপটে স্বীকার করবেন। শুধু বাংলাদেশই-বা বলি কেন, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে যে ভয়াল অন্ধকার অক্টোপাশের মতো অষ্টবাহু প্রসারিত করছিল তার বিপরীতে আলোর একমাত্র উৎস ছিলেন ফিদেল এবং তার কিউবা। বললে অত্যুক্তি হবে না যে তিনি ছিলেন শতাব্দীর সূর্য। গোটা শতাব্দীব্যাপী তিনি একাই আগুনের পরশমণি হয়ে আলো ছড়িয়েছেন অন্ধকারের রাহুগ্রস্ত ধরিত্রীজুড়ে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে শতাব্দীর সেই সূর্য অস্তমিত হয়েছে। কে না জানেন, যে অস্ত থেকে উদয়ের দূরত্ব খুব বেশি নয়। দেহের অবসান আছে, কিন্তু মানবিকতার যে-সূর্য তার মৃত্যু নেই। ন হন্যতে; হন্য মানে শরীরে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক