কেন বারবার গুজরাটে ছুটে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি?

Date:

Share post:

ভারতের ্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রবিবার আরও একবার নিজের রাজ্য গুজরাটে গিয়ে শত শত টাকার বিভিন্ন প্রকল্পের দ্বোধন করেছেন।

অক্টোবর মাসে এই নিয়ে তিনি তিনবার গুজরাটে গেলেন, এ বছরে প্রায় বারদশেক তার ওই রাজ্যে সফর করা হয়ে গেল। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, কেন তিনি এত ঘন ঘন গুজরাটে যাচ্ছেন?

অথচ যে গুজরাটে তিনি টানা প্রায় তেরো বছর মুখ্যমন্ত্রীর পদে ছিলেন, সেখানে প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দুবছরে তিনি প্রায় যাননি বলেই চলে।

ভারতে রাৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, গুজরাটে আসন্ন নির্বাচনে শাসক দল বিজেপি রীতিমতো কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে – আর সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলাতেই এটা প্রধানমন্ত্রীর মরিয়া চেষ্টার অংশ।

ভারতে নোট বাতিল ও ‘জিএসটি’ কর চালু করার জেরে গুজরাটের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ, এটা কোনও গোপন কথা নয়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পাতিদার সমাজ বা দলিতদের ক্ষোভ।

এই তীব্র ক্ষোভ সামাল দিতেই ভোটের আগে শেষ মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী মোদি গুজরাটে উন্নয়নের বন্যা বইয়ে দিতে চেষ্টা করছেন, রাজ্যে তার একের পর এক সফর থেকে সেরকমটাই মনে হচ্ছে।আহমেদাবাদে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের উদ্বোধনে শিনজো আবে ও নরেন্দ্র মোদি

গত মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে মিলে তিনি আহমেদাবাদে এসে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেছেন। ঠিক তার পরের সপ্তাহেই আবার গুজরাটে এসে উদ্বোধন করেছেন নর্মদা নদীর ওপর সর্দার সরোবর বাঁধ প্রকল্প।

অক্টোবরের ৮ তারিখে আবার দুদিনের সফরে গুজরাটে এসে তিনি গান্ধীনগর, রাজকোট ও নিজের শহর ভাডনগরে বহু প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। অক্টোবরের ১৬ তারিখে আবার গুজরাটে গিয়ে গান্ধীনগরে বিশাল জনসমাবেশে ভাষণ দেন।

আজ রবিবারেও তিনি গুজরাচের ভাদোদরাতে ১১৪০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প হয় চালু করেছেন, কিংবা তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন।

গুজরাটের ঘোঘা ও দহেজ শহরের মধ্যে ক্যাম্বে উপসাগরের ওপর দিয়ে ৬৫০ কোটি টাকার একটি ফেরি পরিষেবাও এদিন চালু করেছেন তিনি, যার পরিকল্পনা চলছিল প্রায় গত পঞ্চাশ বছর ধরে। এই ফেরি চালু হওয়ার ফলে ওই দুই শহরের মধ্যে দূরত্ব সাত-আট ঘন্টা থেকে কমে মাত্র এক ঘন্টায় দাঁড়াবে।

বিরোধী কংগ্রেস অবশ্য অভিযোগ করছে, প্রধানমন্ত্রীকে এই সব প্রকল্প উদ্বোধনের সুযোগ করে দিতেই মিশন গুজরাট নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনও ঘোষণা করেনি।

কারণ নির্বাচনী তফসিল একবার ঘোষণা হলেই মডেল ৎ হয়ে যায়, যখন সরকার আর এই জাতীয় প্রকল্পের উদ্বোধন বা শিলান্যাস করতে পারে না। নির্বাচন কমিশন অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।গুজরাটে পাতিদার সমাজের নেতা হার্দিক প্যাটেল

তবে কমিশন এটা একরকম জানিয়েই দিয়েছে, আগামী ১৮ ডিসেম্বর হিমাচল প্রদেশের সঙ্গেই গুজরাট রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেরও ভোটগণনা হবে। যার অর্থ, গুজরাটেও ভোটপ্রক্রিয়া মিটে যাবে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধেই।

কিন্তু নির্বাচন সামনে ঘনিয়ে এলেও এটা স্পষ্ট, সাড়ে তিন বছর আগে মোদি প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়ে দিল্লি চলে যাওয়ার পর গুজরাট বিজেপিতে যে ‘নেতৃত্বের শূন্যতা’ তৈরি হয়েছিল তা তারা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

মোদি ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে গুজরাটের ভাডোডরা ও উত্তরপ্রদেশের বারাণসী – দুটো আসন থেকেই জিতেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি গুজরাটের আসনটি ছেড়ে দেন, এমপি হিসেবে তার যাবতীয় মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয় উত্তরপ্রদেশেই।

নরেন্দ্র মোদির পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন আনন্দীবেন প্যাটেল। কিন্তু রাজ্যে প্যাটেলদের বিক্ষোভ ঠিক মতো সামলাতে না-পারা ও আরও নানা ব্যর্থতার অভিযোগে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়, বিজেপি মাসকয়েক আগে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসায় তুলনামূলকভাবে লো-প্রোফাইল বিজয় রুপানিকে।

গত বছরদুয়েকের মধ্যে গুজরাটে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে করে উঠে এসেছেন হার্দিক প্যাটেল, অল্পেশ ঠাকোর বা জিগনেশ মেভানির মতো বিভিন্ন তরুণ নেতা – যাদের কোনও ৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না।বাইশ বছরের হার্দিক প্যাটেল গুজরাটের প্যাটেল বা পাতিদার সমাজের একজন নেতা – যারা রাজ্যের জনসংখ্যার ১২ শতাংশ।

রাজ্যের রাজনীতি ও ব্যবসার জগতে প্যাটেলরা ক্ষমতাশালী হলেও তাদের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হারও খুব বেশি – ফলে হার্দিক প্যাটেল যখন পাতিদারদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের দাবি তোলেন, তা তোকে খুব দ্রুত জনপ্রিয় করে তোলে।

অন্যদিকে অল্পেশ ঠাকোর রাজ্যের ওবিসি (‘আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস’ বা অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণী) এবং জিগেনেশ মেভানি রাজ্যের দলিতদের কন্ঠস্বর হিসেবে গুজরাটের বিজেপি সরকারকে চাপের মুখে ফেলে দেন। ভোটের ঠিক আগে অল্পেশ ঠাকোর কংগ্রেসেও যোগ দিয়েছেন।

উনা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে দলিতদের ওপর নির্মম অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে, তাতে তারাও গুজরাটের বিজেপি সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। গুজরাটের প্রায় দশ শতাংশ মুসলিম ভোটারদেরও কখনওই বিজেপির সমর্থক বলে ধরা হয় না।

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের অবস্থা দেশের অন্যান্য অনেক রাজ্যে রীতিমতো ছন্নছাড়া হলেও গুজরাটে কিন্তু তারা যথেষ্ঠ শক্তিশালী। ২০১৪-র পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে তারা অনেক ক্ষেত্রেই বিজেপির চেয়েও ভাল ফল করেছে।সম্প্রতি গুজরাটে এই সর্দার সরোবর প্রকল্পেরও উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি

এই পটভূমিতে গুজরাটে ২০১৭র বিধানসভা নির্বাচন বিজেপির জন্য যে সহজ হবে না, পর্যবেক্ষকরা প্রায় সবাই সে ব্যাপারে একমত। দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ ও জাতপাতের সমীকরণ – সব মিলে গুজরাটের ভোট বিজেপির জন্য এক কঠিন পরীক্ষা হতে যাচ্ছে।

অথচ গত প্রায় বাইশ-তেইশ বছর ধরে গুজরাটে একটানা ক্ষমতায় আছে বিজেপি। ভারতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই , হিন্দুত্ববাদী এই দলটির জন্য গুজরাট হল ‘হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি’ – যেখানে তারা তাদের ধর্মীয় মতবাদ ও সংশ্লিষ্ট নীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে আসছে বহুদিন ধরে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী সাফল্যের মূলে ছিল যে উন্নয়নের তাস, তারও প্রধান বিজ্ঞাপন ছিল তথাকথিত ‘গুজরাট মডেল’। সে রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা শিল্পায়নের সাফল্যকেই এক কথায় অনেকে বলতেন গুজরাট মডেল।

সেই গুজরাট যাতে কিছুতেই বিজেপির হাতছাড়া না-হয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তা নিশ্চিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন বোঝাই যাচ্ছে। আর সে জন্যই দিল্লিতে বাকি সব কাজ ফেলে প্রতি সপ্তাহে নিজের রাজ্যে ছুটে যেতেও তিনি দ্বিধা করছেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

গোপালগঞ্জে আরও বাড়ল কারফিউয়ের সময়

গোপালগঞ্জে আবারও বাড়ানো হয়েছে কারফিউয়ের সময়সীমা। আগামীকাল সকাল পর্যন্ত জেলায় কারফিউ বলবৎ থাকবে। শনিবার (১৯ জুলাই) জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের...

জামায়াত আমিরকে দেখতে হাসপাতালে মির্জা ফখরুল

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার (১৯ জুলাই)...

রংপুরে গ্যাসস্টেশনে বিস্ফোরণে নিহত ১, আহত ২০

রংপুরে একটি এলপিজি গ্যাস স্টেশনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে এখন পর্যন্ত একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত...

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের সমাবেশ চলছে

সাত দফা দাবিতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশ শুরু হয়েছে। আজ শনিবার দুপুর সোয়া ২টার...