সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ১৯তম দিনে (২০২৪ সালের ১৯ জুলাই) সারা দেশে দ্বিতীয় দিনের মতো ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে অন্তত ৬৭ জন নিহত হয়। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই নিহত হয় ৬২ জন।
আর রাজধানীর বাইরে রংপুরে দুজন, সাভার, সিলেট ও নরসিংদীতে একজন করে মোট পাঁচজন প্রাণ হারায়।
শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দিনের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে এদিন (১৯ জুলাই) সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনা আগের কয়েক দিনকে ছাড়িয়ে যায়। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এদিন রাতে দেশে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে ১৯ জুলাই প্রাণহানির একাধিক সংখ্যা পাওয়া যায়।
তবে সর্বোচ্চ ৬৭ জন নিহতের সংবাদ প্রকাশ করে শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ। নিহত ও আহতদের মধ্যে বিক্ষোভকারী, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পথচারী, রাজনৈতিক দলের কর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে। কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় তিন দিনেই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়।
১৬, ১৮ ও ১৯ জুলাই প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও ১৭ জুলাইয়ের সহিংসতায় কারো প্রাণহানি হয়নি।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় এদিন রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। তবে জরুরি পরিষেবা কারফিউয়ের আওতামুক্ত থাকবে বলে জানানো হয়। নৈরাজ্য করলে দুর্বৃত্তদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তথ্য অনুযায়ী, এদিন মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আটক করা হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকারবিরোধীদের হাতে চলে গেছে। গণভবনে ১৪ দলের বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের দাবি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন অরাজনৈতিক। কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করলে তা তারা সমর্থন করেন না।
পরিস্থিতি সামাল দিতে এদিন সারা দেশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৩০০ প্লাটুন সদস্য মোতায়েন করা হয়। আগের দিন রাতের ধারাবাহিকতায় এদিনও ইন্টারনেট সেবা ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। রাজধানী ছিল কার্যত বিছিন্ন ও অচল। রাজধানী থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। বাসের পাশাপাশি বন্ধ ছিল রেল যোগাযোগও। ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক অনেক ফ্লাইটও বাতিল করা হয়।
এদিন ঢাকা মহনগরীতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তবে তা উপেক্ষা করে রাজধানীসহ সারা দেশে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরনো ভবনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। মেট্রো রেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর ১০ স্টেশনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ছাড়া রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে যানবাহন, বিভিন্ন স্থাপনা, সরকারি দপ্তর ও রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়।
এদিন আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়ার অভিযোগ ওঠে। তবে র্যাবের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। র্যাব জানায়, তারা আকাশ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। হেলিকপ্টার থেকে কোনো গুলি ছোড়া হয়নি, বরং উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয়েছে।’
এদিন বিকেলে বিএনপির পূর্বঘোষিত সমাবেশকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হলে পল্টনসহ আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সন্ধ্যায় গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কোটা আন্দোলনে তাঁদের পরিপূর্ণ সমর্থন আছে। যতক্ষণ না শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায় এবং সরকারের পতন না হবে ততক্ষণ আন্দোলন চালাবেন তাঁরা।
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় এদিন বিকেলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ তাঁর অনুসারীদের ওপর হামলা হয়। জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী জুয়েল মোল্লাকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গুরুতর আহত হন জাহাঙ্গীরসহ অনেকে।
রাজধানীর বাইরে সিলেট, মুন্সীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, মাদারীপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, বগুড়া, চট্টগ্রাম, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ একাধিক স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্ব নির্ধারিত ২১ জুলাইয়ের স্পেন সফর স্থগিত করেন।
জাতির কাছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনাসহ ৯ দফা দাবি শিক্ষার্থীদের
এদিন আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক সরকারের তিন মন্ত্রীর সঙ্গে রাতে দেখা করে প্রথমে আট দফা দাবি পেশ করেন। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে ৯ দফার ঘোষণা দেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, কয়েকজন সমন্বয়কের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেছে, তাঁরা বৈঠক করে ৯ দফা দাবি ঠিক করেছেন।
৯ দফা দাবির মধ্যে প্রথমে ছিল ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এ ছাড়া সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ, যেসব এলাকায় ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার পুলিশের ডিআইজি ও পুলিশ সুপারকে বরখাস্ত করা, অভিযুক্ত পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের আটক ও হত্যা মামলা দায়ের করা, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ও ছাত্রসংসদ চালু করার দাবি জানানো হয়।
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় অভিভাবকদের প্রতিবাদ
রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় ‘সর্বস্তরের অভিভাবক সমাজ’ ব্যানারে আয়োজিত এক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান অভিভাবকরা। দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবিও জানান তাঁরা।
নরসিংদীতে জেল ভেঙে কয়েদি ছিনতাই, অস্ত্র লুট
এদিন নজিরবিহীনভাবে নরসিংদী জেলা কারাগারের ফটক ভেঙে ৮২৬ জন কয়েদিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে ৯ জন জঙ্গি ছিল বলে জানান জেল সুপার। জেল সুপার জানান, বিকেলে দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কারাগারের মূল ফটক ও পেছনের দুটি ফটক ভেঙে কয়েক হাজার লোক ভেতরে ঢুকে পড়ে। কারাগারের অস্ত্রাগার থেকে লুট হয় ৬৬টি চায়নিজ রাইফেল, ১৯টি শটগান এবং আট হাজার গুলি। কারাগারের অফিসকক্ষ, বন্দিশালাসহ বিভিন্ন ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়।