মধ্যবিত্ত পরিবারের কলেজপড়ুয়া আঠারো বছরের তরুণী।মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ তবুও একটু বিলাসী। ফ্যান্টাসি পছন্দ করেন। টিকটক করা যেন নেশায় পরিণত হয়েছে। সুযোগ পেলেই টিকটক করে পোস্ট করেন। টিকটকের কারণেই অনেক তরুণ-তরুণীর সঙ্গে পরিচয়। ফেসবুকে টিকটক গ্রুপেও বেশ সময় দেন। স্বপ্ন ছিল একদিন টিকটকের বড় মডেল হবেন। ফলোয়ার হবে লাখ লাখ
তাই সবসময় স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পরিচিত টিকটকারদের সঙ্গে নিজের স্বপ্নের কথা শেয়ার করতেন। ছয়মাস আগে তার ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় আরেক টিকটক মডেলের সঙ্গে। ওই মডেল আবার তাকে মোহাম্মদ ইয়াসিন রাতুল নামে এক মডেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর তাদের দু’জনের কথা শুরু হয়। সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। টিকটকের বড় মডেল বানিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাকে রাতুল প্রস্তাব করে নগ্নভাবে ভিডিও কলে আসার জন্য। ভিডিও কলে আসার পর রাতুল কৌশলে নগ্ন দৃশ্য স্ক্রিন রেকর্ডার দিয়ে রেকর্ড করে রাখে। পরে ওই ভিডিও দিয়ে ওই তরুণীর সঙ্গে শুরু করে ব্ল্যাকমেইল। ভিডিও ভাইরাল করে দেয়ার হুমকি দিয়ে হাতিয়ে নেয় টাকা।
শুধু এই তরুনী নয়। এরকম অন্তত অর্ধশত তরুণীর সঙ্গে প্রেম করে শতাধিক ভিডিও সংগ্রহ করেছে রাতুল। যাদের মধ্যে বেশির ভাগ তরুণীই টিকটকের মডেল। তারা বিভিন্নভাবে টিকটক ভিডিও তৈরি করে ফেসবুকে আপলোড করে বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করেন। রাতুলও টিকটকের মডেল। ওই মডেলরা যেসব গ্রুপের সদস্য রাতুলও একই গ্রুপের সদস্য। গ্রুপ থেকে ওই মডেলদের ফেসবুক আইডি নিয়ে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে সখ্যতা গড়ে তুলে। পরে তাদেরকে আরও জনপ্রিয় মডেল বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে নগ্ন ভিডিও সংগ্রহ করে। শুধু তাই নয় বিভিন্ন উঠতি মডেলদের সঙ্গে প্রেম করে রাতুল বিভিন্ন স্থানে তাদের সঙ্গে দেখা করে। পরে কৌশলে তাদের মোবাইল চুরি করে নিয়ে আসে। মোবাইলে চালু থাকা ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটঅ্যাপস, জিমেইল, বিকাশের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে নিয়ে যায়। নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর রাতুল বিকাশে টাকা থাকলে তুলে নেয়। মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ওই তরুণীর ঘনিষ্ঠ সুন্দরী বান্ধবীদের মেসেজ করে। বান্ধবী সেজে আরেক বান্ধবীকে রাতুল নিজেই তার প্রশংসা করে। ছদ্মবেশে সে নিজেই তার সঙ্গে কথা বলার রিকুয়েস্ট করে। ফেসবুক আইডি লিংকও দেয়। এভাবে এক তরুণীর মাধ্যমে অন্য তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক করে তাদেরও ভিডিও সংগ্রহ করে। তবে রেহাই মেলেনি। এক তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) রাতুলকে গ্রেপ্তার করে।
সিআইডি জানিয়েছে, রাতুল দেখতে স্মার্ট। কথা বলে গুছিয়ে। গরিব ঘরের ছেলে হলেও প্রতারণার টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করে। কখনো আবার মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য মিথ্যা ছবি তুলে তরুণীদের কাছে পাঠাতো। উবারের গাড়িকে নিজের গাড়ি হিসেবে প্রচার করতো। সমাজের বিশিষ্টজন ও নামিদামি মডেলদের সঙ্গে কৌশলে ছবি তুলে ফেসবুকে দিতো। বিভিন্ন স্থানে মিথ্যা দান করছে এমন ছবি তুলে রাখতো। এ ছাড়া নিজে সুন্দর সুন্দর টিকটক করে আপলোড করতো। সবমিলিয়ে অনেক তরুণী খুব সহজেই তার ফাঁদে পড়ে যেতো। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ফেইক আইডি দিয়ে যখন তরুণীদের সঙ্গে প্রেম করতো তখন রাতুল বিশেষ সফটওয়ারের মাধ্যমে মেয়ে কণ্ঠে কথা বলতো। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তরুণীদের আস্থা অর্জন করে। যেসব তরুণীর মোবাইল চুরি করতো ওই মোবাইলের সব তথ্য সংগ্রহ করে ফরমেট দিয়ে বিক্রি করে দিতো।
সিআইডি জানায়, মোহাম্মদ ইয়াসিন রাতুলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার এক্তারপুর গ্রামে। সে ওই এলাকার মোহাম্মদ আবু তাহের ও ফাতেমা বেগমের ছেলে। সেখানে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে ঢাকার মিরপুরে চলে আসে। প্রথমে স্থানীয় এক নেতার বাসায় চা বয় হিসেবে কাজ নেয়। পরে মোহাম্মদপুর রিং রোডের এক শো-রুমে সেলসম্যানের চাকরি নেয়। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দিয়ে অপরাধের পথে পা বাড়ায়। যৌন ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কাজে জড়িয়ে পড়েন। রাতুলকে যখন সিআইডি গ্রেপ্তার করে তখন তার কাছ থেকে প্রতারণা এবং ব্ল্যাকমেইলে ব্যবহৃত দুটি মোবাইল সেট,১০টি সিম পাওয়া যায়। এ ছাড়া চারটি ফেইক ফেসবুক আইডি এবং ৯টি জিমেইল অ্যাকাউন্ট পাওয়া যায়।
মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী এক তরুণী উল্লেখ করেছেন,আমি একটি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী। ২০২০ সালের জুন মাসে ফেসবুকে মেহজাবিন মুনের মাধ্যমে তানজুমা আফরোজের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। মুন আমাকে বলে তার আফরোজ নামে এক বোন আছে। মেয়েদের কাজে আগ্রহ থাকলে কাজ দিয়ে সহযোগিতা করে। তারপর আমাকে আফরোজের আইডির লিংক দেয়। তারপর থেকেই আমাদের নিয়মিত কথা শুরু হয়। একদিন হুট করে আফরোজ আমাকে বলে তার এক ছোট ভাই আছে মোহাম্মদ ইয়াসিন রাতুল। পরে রাতুলের সঙ্গে আমার পরিচয়, কথা ও দেখা হয়। কথা বলতে বলতে আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। ৫/৬ মাস সম্পর্কের মধ্যে রাতুলের সঙ্গে আমার তেমন দেখা হয়নি। ২০২০ সালের ৩১শে অক্টোবর মিরপুরে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তখন আমাকে লঞ্চে চাঁদপুর ভ্রমণের প্রস্তাব দেয়। আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। লঞ্চে আমাদের সঙ্গে আমার বন্ধু অনিক ও তার বান্ধবী শ্রাবণী ছিল। লঞ্চে যাত্রার কিছু সময় পর অনিক ও শ্রাবণী ছাদে চলে যায়। আর এই সুযোগে রাতুল লঞ্চের কেবিনে নিয়ে কৌশলে আমার মোবাইলে আমারই নগ্ন ভিডিও ধারণ করে। পরেরদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আমরা সদরঘাট এসে পৌঁছাই। লঞ্চ থেকে নামার পর আমাকে বলে তার ভাইয়ের গাড়ি আনতে হবে। তার মোবাইলে ব্যালেন্স নাই। তাই আমার মোবাইলটা দেয়ার জন্য। আমার মোবাইল নিয়ে কথা বলতে বলতে কিছুটা দূরে চলে যায় রাতুল। তখন তার কাছে আমার হাতব্যাগ ছিল। যার মধ্যে ৩০ হাজার টাকা ছিল। আমি প্রায় দুই ঘণ্টা যাবৎ সেখানে অপেক্ষা করি। কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি। আমার সন্দেহ বাড়তে থাকে। পরে আমি অনিক ও শ্রাবণীর মোবাইল দিয়ে ট্রাই করে দেখি আমার মোবাইল বন্ধ। তখন আমি বুঝতে পারি আমি প্রতারকের পাল্লায় পড়েছি। তাই ওইদিনই ওই মোবাইলে থাকা দুটি সিম আমি রিপ্লেস করি।
ভুক্তভোগী তরুণী আরও বলেন, সিম রিপ্লেস করে বুঝতে পারি আমার বিকাশ থেকে কিছু টাকা ক্যাশআউট করে নিছে। তার ঠিক পরেরদিন রাতুল তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। পূর্বের ধারণ করা নগ্ন ভিডিও দিয়ে আমাকে হুমকি দিয়ে টাকা চায়। মিটমাট করার জন্য ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে। না হলে ভিডিও ভাইরাল করে দিবে। আমি টাকা দিতে অপারগতা জানালে আমার ভিডিও ইউটিউবে আপ করা হচ্ছে বলে স্ক্রিনশট আমাকে পাঠায়। উপায়ন্তর না পেয়ে আমি সিআইডি’র সাইবার পুলিশের সহযোগিতা নেই।
সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রেজাউল মাসুদ মানবজমিনকে বলেন, রাতুল খুব চতুর প্রকৃতির ছেলে। তাকে দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম লাগে। বড় বড় সেলিব্রেটি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতির সঙ্গে ছবি তুলে প্রচার করতো। বিভিন্ন স্থানে মিথ্যা দান করছে এমন ছবি তুলে ফেসবুকে দিতো। এ ছাড়া সুন্দর সুন্দর টিকটকের ভিডিও করতো। এসব ছবি, ভিডিও দেখে মেয়েরা তার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতো। আর এই সুযোগে সে ওই মেয়েদের টিকটক মডেল করার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে নগ্ন ভিডিও সংগ্রহ করতো। আমরা যখন তার মোবাইল আমাদের হেফাজতে নেই তখন তার মোবাইলে শুধু বিভিন্ন তরুণীদের নগ্ন ভিডিও পাই। বেশির ভাগই ভিডিও কলে কথা বলার সময় রেকর্ড করা। এক তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। শিগগিরই আমরা তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিবো।