ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় সহিংসতার পেছনের কারণ কী

Date:

Share post:

চলতি মাসের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের এক রাজ্যে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ফেসবুকে ১৭ বছর বয়সী এক ছাত্র কাবাঘর নিয়ে ফটোশপ করা এক ছবি ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার পর ওই ঘটনাটি ঘটে।

ওই দাঙ্গায় একজন প্রাণ হারিয়েছে আর অনেকে আহতও হয়েছে। বিবিসি হিন্দি সার্ভিসের নিতিন শ্রীবাস্তব দাঙ্গায় বিধ্বস্ত ওই এলাকা ঘুরে দেখে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।

চব্বিশ পরগনা জেলার বাদুরিয়া অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রাম মাগুরখালিতে যখন বিবিসি সাংবাদিক পৌঁছালেন তখন ঝুম বৃষ্টি পড়ছিলো, আর তা দেখে ওই গ্রামেরই বাসিন্দা রিনা মণ্ডল বললেন “যেদিন কজন বিক্ষুব্ধ মানুষ আমার হিন্দু প্রতিবেশীদের বাড়ি জ্বালায়ে দিলো সেদিন যদি এমন বৃষ্টি হতো তাহলে হয়তো ঘরগুলো জলতোনা “।

পাঁচ সদস্যের মুসলিম পরিবারটি মাত্র রাতের খাবার শেষ করে উঠেছিল, সেই সময় শ’খানেক মানুষ হাতে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে এসে এক কিশোরকে খুঁজছিলো যে কিনা ওই বিতর্কিত কার্টুনটি পোস্ট করেছিল।

“আমরা ওইসব মানুষদের এর আগে কখনোই এলাকায় দেখিনি,আমি নিশ্চিত ওরা বাইরের কেউ “-বলেন মিসেস মণ্ডল।

“আমি জন্ম থেকে এই এলাকার মানুষদের দেখছি কখনোই এরকম সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা দেখিনি। আমাদের শিশুদের রান্নাঘরে লুকিয়ে রেখেছিলাম এবং পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম”।

“আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারিনা আমার প্রতিবেশীদের তারা মারতে এসেছিলো, যারা কিনা ঈদে আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসে। আর আমরাও পূজায় যাদের বাড়িতে খাবার খাই “-বলেন তিনি।

মিসেস মণ্ডল ছাড়াও স্থানীয় অনেক মানুষ জানালেন সেদিনের আক্রমণকারীরা আসলে তাদের গ্রামের কেউ ছিলোনা এবং দাঙ্গার ঘটনার পর তারা গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।

ওই কিশোর আর তার পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে ছিলোনা, ফলে আক্রমণকারীরা তাদের বাড়িতে আগুন দিয়ে চলে যায়।

যদিও পরে ওই ১৭ বছরের কিশোরকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল।

ওই পোস্টটির কারণে বসিরহাট ও তেতুলিয়া এলাকাতেও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল।

এরপর কিছুদিন বিক্ষুব্ধ মানুষ বিভিন্ন পুলিশ স্টেশন, সরকারি অফিস ও রাজনীতিকদের অফিসে আগুন দেয় এবং অনেক যানবাহনও ভাংচুর করে।.

এমনকি কয়দিন পর্যন্ত ওই এলাকার মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা পায়নি, স্কুল ছিল বন্ধ, হাসপাতালে যেতেও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে -কারণ রাস্তাঘাট বন্ধ ছিল।

সে সময় যে ক্যামেরা ভাংচুর হয়েছে আর সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ হয়েছে তাতে স্থানীয়রাও খুব মর্মাহত।

“যা ঘটেছে দুঃখজনক, কিন্তু যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বড় ক্ষত তৈরি করেছে এবং অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এটি দাগ কেটেছে ‘ বলেন অনিন্দ্য আচার্য , যিনি একজন আইনজীবী। কিন্তু ওই দাঙ্গার ঘটনার পর সপ্তাখানেক কোর্টে যেতে পারেননি তিনি ।

তৃণমূল কংগ্রেস পার্টি শাসিত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী গত ১৮ মাসে অন্তত সাতটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা দেখেছেন।

মালদা, ধুলাগড়, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান এবং জালাঙ্গি -এই এলাকাগুলোতে বেশ কয়েকবার হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে।

বলা হচ্ছে যে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে যাতে বহু হতাহত হচ্ছে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এবং অনেক পরিবারকে উচ্ছেদও করা হয়েছে।

যে কিশোরের পোস্ট নিয়ে এত উত্তেজনা, তার এক বন্ধু বিবিসির সাংবাদিককে জানান,”ইন্টারনেট সস্তা হবার পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাক্টিভ হলাম”।

“সেদিন আমরা দুজন একসাথে ছিলাম। একটা পোস্টের কারণে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে তা আমরা ভাবতেই পারিনি”- বলেন ওই কিশোরের বন্ধু।

“নিরাপত্তার কথা ভেবে আমার পরিবার চারদিনের জন্য আমাকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আর কখনোই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবোনা বলে প্রতিজ্ঞা করেছি”।

ওই এলাকায় অনেক লোকের সাথে কথা বলেছেন নিতিন। এলাকার অনেকের কাছে সেদিনের দাঙ্গার ছবি রয়েছে। পুড়ে যাওয়া দোকান, যানবাহনের ছবি। কিন্তু সেসব ছবি কোথা থেকে আসলো, ছবিগুলো আসলে সেই দাঙ্গার কিনা সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই এলাকার বাসিন্দাদের।

ওই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও জাতীয় গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজ্য সরকার ঘটনার বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দেন ও দাঙ্গার ঘটনায় জড়িতদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনার প্রতিজ্ঞা করেন।

ওই দাঙ্গার ঘটনায় রাজনৈতিক পটও কিছুটা পাল্টে যায়।

রাজ্যের গভর্নর ও ভারতীয় জনতা পার্টির সাবেক নেতা কেশরী নাথ ত্রিপাঠির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়।

ঘটনার কদিন পরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এক ঘোষণায় জানান, সব ধর্মের প্রতিনিধি, স্থানীয় ক্লাব, ছাত্র-যুবদের নিয়ে রাজ্যের প্রায় ৬০ হাজার নির্বাচনী বুথ ভিত্তিক শান্তি বাহিনী তৈরী করবে পুলিশ প্রশাসন।কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা যাতে না ছড়ায়, তার জন্য নজরদারির কাজ চালাবে এই বাহিনী।

তবে বিরোধী দলগুলো মনে করছে নিজের প্রশাসনের ব্যর্থতা ঢাকতেই মমতা ব্যানার্জী শান্তি বাহিনী তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বিজেপি’র কয়েকজন এমপি এবং বিরোধী দলীয় নেতাদের দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকায় যেতে সম্মতি দেয়নি রাজ্য সরকার এবং তা নিয়ে বেশ ক্ষুব্ধও হন তারা।

রাজ্যটিতে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন রাজ্যের গভর্নর এবং বিজেপির অনেক নেতা।

এমনকি তারা এটাও অভিযোগ করেন যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতায় থাকার জন্য ‘মুসলিমদের সঙ্গে অতিরিক্ত সংহতি’ প্রকাশ করছেন।

ভারতে আসামে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান বাস করে, আসামের পর পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত মুসলিমদের সংখ্যা বেশি- রাজ্যটির জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশই মুসলমান।

তবে মিস ব্যানার্জি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন যে “পশ্চিমবঙ্গ কখনোই সাম্প্রদায়িক কোনো কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়নি”।

তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনার পর দেখা গেছে যে বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ধর্মের মানুষ ‘একে অপরের সাহায্যে’ এগিয়ে আসছে।

বসিরহাট ও বাদুরিয়া সীমান্তে অবস্থিত দেগাঙ্গা শহরে ২০১০ সালে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। কিন্তু ওই এলাকার মানুষ সে ঘটনা ভুলে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে ও সব ধর্মের মানুষ একসাথেই চলছে।

“মসজিদ থেকে মাত্র একশো মিটার দূরে আমাদের মন্দির” -বলছিলেন এলাকার কালী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত অমর ব্যানার্জী।

“শান্তিপূর্ণভাবে আমরা একসাথে প্রার্থনা করি। কিন্তু কিছু মানুষ রাজনৈতিক সুবিধা পাবার আশায় ধর্মকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বাধানোর চেষ্টা করে যেটা খুবই উদ্বেগের বিষয়” -বলেন এই পুরোহিত।

মসজিদ মন্দিরে যারা প্রার্থনা করতে আসা তারা মাগুরখালির দাঙ্গার ঘটনা কেন ঘটেছিল সে বিষয়ে জানতে আগ্রহী।

মসজিদটির কাছেই একটি বড় ব্যানার টাঙ্গানো হয়েছে, যেখানে লেখা আছে যে ওই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস-আস্থা আছে, তারা বন্ধুর মতো একসাথে বাস করছে।

মসজিদের ইমাম মুহাম্মদ আজমত আলী বলছেন “যেখানেই আপনি যান না কেন হিন্দু -মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি দেখবেন। একটা ভালো সম্পর্ক দেখবেন। শুধু প্রতিবেশী নয় ব্যবসাক্ষেত্রেও পারস্পরিক বন্ধুত্ব বজায় রয়েছে সবার মধ্যে”।

“তাহলে কে বলে যে আমরা দুই বিপরীত ধর্মের মানুষ?”

Source from: http://www.bbc.com/bengali/news-40715265

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related articles

আবারো এস আলমে আগুন 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় এস আলম গ্রুপের চিনির গুদামের পর এবার তেলের মিলে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের...

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার চেষ্টার সময় গুলি বিনিময়

সময় ডেস্ক সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে অন্য একটি জাহাজ। দুই...

শেষ ম্যাচে ভুটানকে উড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ

সময় স্পোর্টস ডেস্ক সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশের মেয়েরা। ১০ মার্চ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে মাঠে...

নারী দিবসে নারী কর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবারই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন নারী কর্মীরা

সময় ডেস্ক আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন নারীরা। রাজধানীর শাহজালাল...