শাহেদ আর নাদিয়া দুজনে বিয়ের পর থেকেই শহরে বাসা নিয়ে থাকছে৷ সকালে শাহেদ অফিসে চলে গেলে নাদিয়া একা একাই থাকে,ঘরের কাজ করে,বই পড়েই সময় কাটায়৷ পাশের ফ্লাটে মিসেস তানিয়া থাকেন, মাঝে মাঝে তার সাথেও গল্প করেন৷ একদিন হুট করেই নাদিয়ার শ্বাশুরী এলো তাদের বাসায়৷ নাদিয়া একটু অবাক হলো, কারন তার শ্বাশুরী খুব একটা আসেন না৷ সেদিন বাসায় মিসেস তানিয়া ও ছিলেন৷ নাদিয়া তাদেরকে চা নাশতা দিলো৷
“মা আপনি হঠাৎ এই ভর দুপুরে এলেন,সব ঠিক আছে তো?”
“হ্যা বৌমা, কিন্তু তোমার শ্বশুরের শরীরটা বেশি ভালোনা, অনেকদিন ধরেই তোমাদের কথা মনে পরছিলো তাই চলে এলাম৷
বৌ শ্বাশুরির গল্প দেখে মিসেস তানিয়া সে মূহুর্তে বিদায় নিলেন৷
“মা আপনার জন্য কি থাকার ব্যাবস্থা করবো?”
“না না আমি একটু পরই চলে যাবো, তোমার কাছে বাড়তি চাদর থাকলে এনে দাও ,বাহিরে প্রচন্ড ঠান্ডা পরছে৷”
নাদিয়া উপরে চলে যেতেই ওর শ্বাশুরী রান্নাঘরের দিকে গেলো৷ কিছু একটা খুজতে লাগলেন এবং সেটা পেয়েও গেলেন, তার ব্যাগে ঢুকিয়ে আবার সোফায় গিয়ে বসলেন৷
নাদিয়া হাসি মুখে তার শ্বাশুরীকে বিদায় দিলো৷ যাওয়ার আগে তার শ্বাশুরী বারবার অনুরোধ করলো সে যে এসেছে এটা যেনো তার ছেলে না জানতে পারে৷ এরপর সে তার ঘরের কাজে মন দিলো৷ শাহেদ এর অপেক্ষায় বসে রইলো৷
সে রাতে নাদিয়া অদ্ভুত ভয়ানক স্বপ্ন দেখতে লাগলো৷ তার স্বামীর সারা শরীরে রক্ত ,আবার দেখতে লাগলো কিছু একটা নাদিয়ার চুল পেঁচিয়ে শরীরে পেঁচাচ্ছে৷ একটা সময় চিৎকার করে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো৷
পরদিন সকালে শাহেদ অফিসে যাওয়ার পর রান্না ঘরে দেখলো কারো রক্তাক্ত পায়ের ছাপ, সে ভয় পেয়ে তারাতারী মেঝে মোছা শুরু করলো৷
এরপরই মিসেস তানিয়ার ঘরে গেলো৷ সেখানে গি়য়ে কিছুক্ষন গল্প করার পর কাল রাতের ঘটনা থেকে শুরু করে সব শেয়ার করলো৷ তানিয়া তাকে বুঝালো একা থাকার কারনে মনের মধ্যে এরকম ভয় চলে এসেছে,একটা বাচ্চা নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ তার কথা শুনে মনে হলো এটা শুধুই একটা ভ্রম, সে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো৷
আজকের সন্ধ্যেটা যেনো কেমনই, পুরো বিল্ডিংয়ে কারেন্ট নেই৷ বিচ্ছিরি অবস্থা গরমের মধ্যে৷ নাদিয়া মোমবাতি ধরিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখলো একটা মেয়ের সাথে শাহেদ শুয়ে আছে!
চিৎকার করে শাহেদ কে ডাকতেই শাহেদ ডাইনিং রুম থেকে দৌড়ে এলো, দেখলো কেউই নেই বিছানায়৷ তার কিছুক্ষনের মধ্যেই কারেন্ট চলে এলো কিন্তু নাদিয়া সারা রাত ভয়ানক জ্বরের প্রকোপে ঘুমাতে পারলোনা৷ শাহেদ কি কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেলো, নাকি এটাও ওর একটা ভ্রম৷ এসব দুঃশ্চিন্তা করতে করতে ও তো পাগল হয়ে যাচ্ছে প্রায়!
পরদিন সকালে ও সিদ্ধান্ত নিলো একটু শ্বশুর বাড়িতে যাবে, তার অসুস্থ শ্বশুর কে দেখে আসবে৷ শাহেদ অফিসে যাওয়ার পর নাদিয়া ও বেরিয়ে পরলো৷
দরজা নক করতেই ওর শ্বাশুরী খুলে দিলো, হঠাৎ ওকে দেখে চমকে উঠলো,আর একটু বিরক্তও হলো৷ তারপর সোফায় বসতে দিলো৷ দেখলো তার প্যারালাইসড শ্বশুর কোন কথাই বলতে পারছেনা,শুধু ভিতরের রুমের দিকে কি যেনো ইশারা করছে৷
“আমি বুড়া বয়সে এর সব সামলাচ্ছি, কি আর দেখতে আসছো, আমার ছেলেটা আমাদের কোনো খোজ খবরই নেয়না! কি জন্ম দিয়েছি, ওর বাপ এরকম বিছানায় পড়ে আছে ,আমি ওর মা এতো ঔষুধের খরচা সামলাচ্ছি কিভাবে একটু খোজও নেয়না৷”
“মা আমি শাহেদকে বলবো আপনার এখানে আসতে, আসলে ওর চাকরীর জন্যই এতো দুরে বাসা নিয়ে থাকতে হচ্ছে৷ আপনি যদি বলেন আমি কিছুদিন থেকে সাহায্য করতে পারি৷”
“না না ওসব দরকার নেই ,তুমি এখন যাও, রাত হয়ে যাবে নয়তো বাড়ি ফিরতে৷ আর সাবধানে থেকো”
বারবার ওর শ্বশুর কিছু একটা ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছিলো কিন্তু বেচারী নাদিয়া কিছু না বুঝেই চলে এলো৷ রাতে আবার শোয়ার পর মনে হলে কেউ একজন নাদিয়ার গলা চেপে ধরে আছে, ওর সমস্ত দেহ অবশ হয়ে আসতে লাগলো, পাশে ওর স্বামীকে চিৎকার দিয়ে ডাকার পরও কোন সাড়া শব্দ পেলোনা৷ মনে হচ্ছে যেনো ওর আওয়াজ টা কারো কাছে পৌছাচ্ছেনা৷
মনে মনে দোয়া পড়া শুরু করে দিলো ,প্রায় ৩ মিনিট পর ছেড়ে দিলো৷ সাড়া রাত ও না ঘুমিয়ে জায়নামাজে দোয়া পড়ে কাটিয়ে দিলো৷
পরের দিন মিসেস তানিয়া আসলেন দেখা করতে, এসেই দেখেন এই ৩ দিনেই নাদিয়া কেমন শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে, চেহারা মলিন হয়ে আছে৷
“কি ব্যাপার তোমার, কি হয়েছে? জামাইর সাথে ঝামেলা? নাকি অন্য কিছু?”
“আমার কি যেনো হয়েছে, পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি,আমার কিছুই ভালো লাগছে না আপু৷”
“আচ্ছা কি সমস্যা ভরসা রেখে বলতে পারো,হয়তো আমি কোন সাহায্য করতেও পারি৷”
তারপর বিগত ৪ দিনের সমস্ত ঘটনা যা যা হয়েছে সব খুলে বললো৷
“হুম বুঝেছি, তুমি আমার সাথে চলো, তোমার এ সমস্যার সমাধান বের করে দিচ্ছি৷”
এরপর ওরা গাড়িতে করে মফস্বল শহরে ঢুকলো, সেখানে একটা ছোট্ট বাসায় কড়া নাড়লো, একটা মেয়ে দরজা খুলে দিলো৷
খাটের উপরে বসা এক বৃদ্ধ মহিলা , তাকে দেখেই ওরা সালাম দিলো৷ এরপর তাকে নাদিয়ার সব ঘটনা খুলে বললো৷
“তোমরা বসো, আমি আসন দিয়ে দেখছি ঘটনা কি”
বেশ কিছুক্ষন পর….
“মেয়ে তুই কপালপোড়া, এমন এক ছেলেকে বিয়ে করেছিস যার মা একটা ডাইনি৷ কালো যাদু করে সে তার নিজের স্বামিকেও বোবা, পঙ্গু করে রেখেছে৷ সে তোকেও যাদু করেছে যেনো শিঘ্রয়ই তোর মরন হয়, আর ২ দিন পর এলে আমি কিছুই করতে পারতাম না”
“কি বলছেন এসব ,আমি এসব যাদু টোনা বিশ্বাস করিনা, আমার শ্বাশুরী বয়স্ক মানুষ নামাজ পড়েন৷”
“৪ দিন আগে সে তোর বাসায় এসেছিলো, সে তোর গায়ের চাদর আর রান্নাঘর থেকে তোর খাওয়ার গ্লাস নিয়েছিলো, আর ময়লার ঝুড়ি থেকে তোর চুল! এগুলো দিয়েই সে তোর সর্বনাশ করতে নেমেছে৷ যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয় তার বাসার শেষ মাথায় বন্ধ রুমে গেলেই সব দেখতে পাবি৷”
“আচ্ছা এখন আমি কি করবো বলুন? উনি কেনো এমন করছে আমি তো তার কোনো ক্ষতি করিনি৷”
“হায়রে আদমজাত,তোরা খুবই বোকা৷ যারা এসব করে তাদের ক্ষতি করা লাগেনা, মন চাইলেই করে৷ সে তার ছেলেকে অনেক ভালোবাসে, তাই সে চায়না তোর সাথে সে সংসার করুক৷ সে তোকে পথ থেকে সড়িয়ে দেয়ার জন্য এসব করেছে৷”
“আচ্ছা এখন আমাদেরকে এসব সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় বলে দিন৷আমি শাহেদকে অনেক ভালোবাসি ওকে নিয়ে শান্তিতে থাকতে চাই৷”
এরপর উনি বললো; “ঠিকাছে করে দেবো, তোমরা এখন বাড়ি যাও৷”
“টাকা কতো লাগবে আপনার?”
“টাকা লাগবেনা এই দাদি টাকার বিনিময়ে কাজ করেন না৷চলো আমরা যাই আশা করি আজ রাতের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে৷”
এরপর ওরা বাড়ি ফিরে আসলো৷
যেই কুফরি যাদু শাহেদের মা করেছিলো নাদিয়ার জন্য, সেটাকে বুমেরাং করে ঘুরিয়ে দিলো ঐ বৃদ্ধা মহিলা৷ যার ফলে নিজের করা যাদুর আছড়ে নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো৷
লেখা-হৃদিতা তাহ্সীন৷