২০০৯ সাল। আমি তখন স্টেজ শো তে বেশ সরব। আমার বড় ভাই জনি তখন এক আবদার করে বসল(সে সুযোগ পেলেই অন্যায় আবদার করে বসে এবং প্রচন্ড রাগ হবার পরও আমি সেটা মেনে নেই)। বগুড়ার এক ছেলে কীবোর্ড বাজায়,মিউজিশিয়ান হিসেবে কেরিয়ার গড়তে চায়। কাজেই আমাকে ছেলেটার দায়িত্ব নিতে হবে,আমার টিম এ ছেলেটাকে কিবোর্ডিস্ট হিসেবে রাখতে হবে।আমি যারপরনাই বিরক্ত হলাম এবং ভাই কে জানালাম ভেবে দেখব। আমার ভাই অতি উৎসাহি। সে নিজ দায়িত্বে ছেলে টা কে ঢাকায় নিয়ে এলো এবং তার বাসায় ফ্রি থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করল। কাজেই বাধ্য হয়েই ছেলেটাকে আমার টিম এ নিতে হল,আমার মিউজিশিয়ান দের গ্রূপে ছেলেটা চার বছর ছিল।আলহামদুলিল্লাহ সে এখন তার পরিবার নিয়ে ঢাকা শহরে ভালো অবস্থানে আছে।
আর একজনের কথা বলছি। তিনি আমার টিম এ অক্টোপ্যাড প্লেয়ার হিসেবে দু বছর বাজিয়েছিলেন।পরবর্তীতে আমার টিম মেম্বার হিসেবে না থাকলেও প্রায়ই যোগাযোগ হত, তার স্ত্রী ও গান করেন। একদিন জানতে পারলাম কিছু ব্যক্তিগত কারণে এখন তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমার চিরাচরিত স্বভাব মত ছুটে গেলাম। জানতে পারলাম এখন তিনি আর প্যাড বাজান না। কারণ তার প্যাড টি বিশেষ প্রয়োজনে বিক্রি করতে হয়েছে, নতুন প্যাড কিনবার টাকা নাই। উনি নিজে এবং উনার স্ত্রী অসুস্থ, হাতে কাজ নেই বলে চিকিৎসা করাতে পারছেন না।আমার স্বামী তাৎক্ষণিক ওনাকে চিকিৎসার জন্য টাকা দেন। পরবর্তীতে আমি উনার কাছ থেকে জানলাম নতুন একটি অক্টোপ্যাড এর দাম পঁয়ষট্টি হাজার টাকা। আমি পুরো টাকাটাই উনার হাতে তুলে দিয়ে বললাম একজন ভাই কে বোনের পক্ষ থেকে উপহার। উনি ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন।
আমার মিউজিশিয়ান দের মধ্যে একজনের বিয়ে, উপহার কি দিব বুঝে পাচ্ছিলাম না অগত্যা উনার কাছে জানতে চাইলাম নতুন সংসারে আসবাব কি আছে? উনি বললেন বিয়ের পর আস্তে আস্তে সব কিনে নিবেন। আমি সেদিনই নতুন দম্পতির জন্য খাট,ড্রেসিং টেবিল এবং আলমারি কিনে পাঠিয়ে দিলাম। ফলাফল এমন উপহার পেয়ে তারা হতভম্ব।
আমার একজন টিম মেম্বার এর দুদিন পর পর মোবাইল চুরি হয়ে যায়। এবার আর বেচারা নতুন মোবাইল কিনতে পারছেন না। আমি দশ হাজার টাকা উনার হাতে দিয়ে বললাম আপাতত এটা দিয়ে কোনো রকম একটা মোবাইল কিনে কাজ চালিয়ে নিন। উনার সেদিনের মুখের হাসি এখনো আমার চোখে ভাসে।
আমার একটা সলো অ্যালবাম এর নাম ‘দুস্টু ছেলে’। এই অ্যালবাম এর গানগুলো সে সময় যারা আমার টিম এ মিউজিশিয়ান হিসেবে ছিলেন তাদের কথা সুর ও সংগীত আয়োজন এ ছিল।আমার এ অ্যালবাম থেকে যে টাকা পেয়েছিলাম তার পুরোটাই আমি নিজের ও আমার মিউজিশিয়ানদের মাঝে সমান ভাবে ভাগ করে দিয়েছিলাম, কণ্ঠশিল্পী হিসেবে একটি টাকাও আমি বেশি রাখিনি !
আমার মিউজিশিয়ান রাও আমাকে অনেক সম্মান করেন, আমার পরিবার কে অনেক ভালোবাসেন আসলে একতরফা আন্তরিকতা বা ভালোবাসা বেশিদিন টেকে না, দুপক্ষকেই একই মন মানসিকতার হতে হয়। আরও এমন অসংখ্য ঘটনা আছে যা বলতে গেলে হয়ত ছোট একখানা বই বের করা যাবে ! মূল কথায় আসি, ইদানিং শুনছি মিউজিশিয়ান দের অনেক ক্ষোভ কণ্ঠ শিল্পীদের প্রতি ! কণ্ঠ শিল্পীরা নাকি বিপদের দিনে মিউজিশিয়ানদের পাশে দাঁড়ান না !
আমার প্রশ্ন হল, ঢালাও ভাবে এই অভিযোগ এর মানে কি? আমি মনে করি কণ্ঠ শিল্পী এবং যন্ত্র শিল্পী একে অন্যের পরিপূরক। আমরা কেউ আলাদা নই। এখন আমরা যে ভয়ংকর সংকট এর ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তার প্রভাব সকল শ্রেণীর ওপর পড়ছে।এখন কেউ আর্থিক ভাবে ভালো অবস্থায় নেই, আমরা সবাই কম বেশি ভবিষৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এখন একে অন্যকে দোষারোপ না করে বরং সবাই মিলে ভাবা উচিত কি করে আমরা এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রান পেতে পারি।
আমি হয়ত আমার সাথে যারা প্রতিনিয়ত বাজান তাদের কথা ভাবতে পারি, তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি কিন্ত তাই বলে সব মিউজিশিয়ান এর পাশে আমার একার পক্ষে কি দাঁড়ানো সম্ভব?
আমি একজন কণ্ঠ শিল্পী হিসেবে অন্য কণ্ঠ শিল্পীদের বিনীত অনুরোধ করছি – আপনাদের সাথে যারা নিয়মিত বাদ্যযন্ত্র বাজান এবং যারা আপনার সহকর্মী তাদের খোঁজ খবর নিন, মানসিক সাহস দিন, প্রয়োজনে আপনার আর্থিক সামর্থ অনুযায়ী সাহায্য করুন। আবার মিউজিশিয়ান দের ও অনুরোধ করছি – আপনাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাদের মাসিক আয় অনেক কণ্ঠ শিল্পীদের চাইতেও বেশি।আপনারাও আপনাদের সহকর্মীর এবং কণ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে যারা ইতিমধ্যেই খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি তাঁদের দুর্দিনে এগিয়ে আসুন।
মানুষই তো মানুষের জন্যে
কন্ঠ শিল্পী ন্যান্সির ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া